তওবা : মহান আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার অনন্য সোপান -ড. মুহাঃ রফিকুল ইসলাম
নামকরণ
সূরার প্রথমে আয়াতের ‘লিমা তুহাররিমু’ শব্দ থেকে এর নাম গৃহীত। তাহরিম অর্থ হারাম করা। এ নামের অর্থ হচ্ছে, এ সূরার মধ্যে একটি হালাল জিনিসকে হারাম করার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে।
নাযিলের সময়
রাসূল সা.-এর মাদানি জীবনের তৃতীয় ভাগে হিজরি ৭ম থেকে ৮ম সালের কোনো এক সময়ে এ সূরা নাযিল হয়।
আলোচ্য বিষয়
উম্মুল মু‘মিনীন যয়নব রা.-এর ঘরে থাকা রাসূল সা.-এর প্রিয় বিশেষ এক ধরনের মধুর শরবত পান করার ব্যাপারে এবং অন্যান্য উম্মাহাতুল মু‘মিনীনদের ইচ্ছা অনুযায়ী তা না খাওয়ার ফয়সালা করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ সূরা অবতীর্ণ হয়। এ ছাড়াও এ সূরায় নবীর মর্যাদা, নবীর স্ত্রীগণের দায়িত্ববোধ, তাওবাতুন নাসুহা বা খাঁটি তওবা ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান দান করা হয়েছে। শেষ দিকে নবীর ঘরে কাফির স্ত্রী এবং কাফিরের ঘরে মুমিন স্ত্রীর দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানো হয়েছে মানুষ যে অবস্থা থাকুক, তার হেদায়াত হওয়া তার ওপরই নির্ভর করে।
ফজিলত
নবী করিম সা. বলেছেন : مَنْ قرأَ سورةَ التحريمِ آتاهُ الله توبةً نصوحاً -‘যে ব্যক্তি সূরা তাহরিম তেলাওয়াত করবে মহান আল্লাহ তাকে প্রকৃত তওবা নসিব করবেন।’
ব্যাখ্যা
অত্র আয়াতে মহান আল্লাহ মুমিনদের নসিহত করেছেন। কালামে হাকিমের যত স্থানে ঈমানদার ব্যক্তিদের আহবান করা হয়েছে, সকল স্থানে মুমিনদের নাজাত এবং সফলতা অর্জনের জন্য নানাধরনের পরামর্শ, নির্দেশ এবং কৌশল বলে দেয়া হয়েছে। এ আয়াত তার ব্যতিক্রম নয়।
আয়াতের প্রথম অংশ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَّصُوحًا ‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহর কাছে তওবা করো, প্রকৃত তওবা’- প্রকৃত বা খাঁটি তওবা কী? এর ব্যাখ্যায় ইবন কাসির র. বলেন,
أَيْ تَوْبَة صَادِقَة جَازِمَة تَمْحُو مَا قَبْلهَا مِنْ السَّيِّئَات وَتَلُمّ شَعَثَ التَّائِب وَتَجْمَعُهُ وَتَكُفُّهُ عَمَّا كَانَ يَتَعَاطَاهُ مِنْ الدَّنَاءَات
অর্থাৎ সত্য, একনিষ্ঠ ও খাঁটি তওবা যার ফলে তোমাদের পূর্ববর্তী পাপসমূহ ক্ষমা করা হবে এবং তওবাকারীর বিক্ষিপ্ত ও এলোমেলো ভাবনাগুলো একত্রিত করা হবে এবং মন্দ স্বভাবসমূহ দূর হয়ে যাবে।
তাওবা নসুহার ব্যাখ্যায় তাফহিম প্রণেতা বলেন: আরবি ভাষায় ( نَصَحَ) শব্দের অর্থ নিষ্কলুষতা ও কল্যাণকামিতা। খাঁটি মধু যা মোম ও অন্যান্য আবর্জনা থেকে মুক্ত করা হয়েছে তাকে আরবিতে (عَسَلٌ ناصِحٌ) বলা হয়। ছেঁড়া কাপড় সেলাই করে দেয়া এবং ফাটা ফাটা কাপড় ঠিক করে দেয়া বুঝাতে আরবি (نَصَّاحَةُ الثَّوب) শব্দ ব্যবহার করা হয় । অতএব, তওবা শব্দের সাথে نَصُوح বিশেষণ যুক্ত করলে হয় তার আভিধানিক অর্থ হবে এমন তওবা যার মধ্যে প্রদর্শনী বা মুনাফিকির লেশমাত্র নেই। অথবা তার অর্থ হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি নিজের কল্যাণ কামনা করবে এবং গোনাহ থেকে তওবা করে নিজেকে মন্দ পারিণাম থেকে রক্ষা করবে। অথবা তার অর্থ হবে গোনাহর কারণে তার দীনদারির মধ্যে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে তওবা দ্বারা তা সংশোধন করবে। অথবা সে তওবা করে নিজের জীবনকে এমন সুন্দর করে গড়ে তুলবে যে, অন্যের জন্য সে উপদেশ গ্রহণের কারণ হবে এবং তাকে দেখে অন্যরাও তার মত নিজেদেরকে সংশোধন করে নেবে।
তাওবা নাসুহার আরো বিস্তারিত অর্থ হলো
যির ইবনে হুবাইশ বলেন, আমি উবাই ইবনে কাবের (রা) কাছে ‘তাওবায়ে নাসূহ’ এর অর্থ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একই প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি বললেন, ” النَّدَمُ تَوْبَة ” এর অর্থ হচ্ছে, অনুশোচনা বা লজ্জাবোধই তওবা। তারপর লজ্জিত হয়ে সে জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং ভবিষ্যতে আর কখনো ঐ কাজ করো না। হযরত উমর (রা), হযরত আবদুল্লাহ (রা) ইবনে মাসউদ, ইবন জারির, ইবনুল কায়্যিম ও উবাই ইবনুল কাব (রা) ‘তাওবায়ে নাসূহ’র পরিচয়ে বলেন :
أَنْ يَتُوب مِنْ الذَّنْب ثُمَّ لَا يَعُود اليه، كما لا يَعُود اللبن إلى الضرع
পাপ থেকে তওবা করা অতঃপর সে পাপের কাছে আর যাবে না, যেমন দুধ পশুর স্তনে ফিরে যেতে পারে না। (ইবনে জারির)
হযরত আলী (রা) একবার এক বেদুঈনকে মুখ থেকে ঝটপট করে তওবা ও ইসতিগফারের শব্দ উচ্চারণ করতে দেখে বললেন, এতো মিথ্যাবাদীদের তওবা। সে জিজ্ঞেস করলো, তাহলে সত্যিকার তওবা কী? তিনি বললেন, সত্যিকার তওবার সাথে ছয়টি বিষয় থাকতে হবে তা হচ্ছে:
(১) যা কিছু ঘটেছে তার জন্য লজ্জিত হও। (২) নিজের যে কর্তব্য ও করণীয় সম্পর্কে গাফিলতি করছ তা সম্পাদন কর। (৩) যার হক নষ্ট করেছ তা ফিরিয়ে দাও। (৪) যাকে কষ্ট দিয়েছ তার কাছে মাফ চাও। (৫) প্রতিজ্ঞা করো ভবিষ্যতে এ গোনাহ আর করবে না এবং (৬) নফসকে এতদিন পর্যন্ত যেভাবে গোনাহর কাজে অভ্যস্ত করেছ ঠিক তেমনিভাবে আনুগত্যে নিয়োজিত কর। এতদিন পর্যন্ত নফসকে যেভাবে আল্লাহর অবাধ্যতার মজায় নিয়োজিত রেখেছিলে এখন তাকে তেমনি আল্লাহর আনুগত্যের তিক্ততা আস্বাদন করাও (কাশশাফ)।
হযরত হাসান রা. বলেন,
التَّوْبَة النَّصُوح أَنْ تُبْغِض الذَّنْب كَمَا أَحْبَبْته وَتَسْتَغْفِرَ مِنْهُ إِذَا ذَكَرْته فَأَمَّا إِذَا جَزَمَ بِالتَّوْبَةِ وَصَمَّمَ عَلَيْهَا فَإِنَّهَا تَجُبُّ مَا قَبْلهَا مِنْ الْخَطِيئَات
বিশুদ্ধ তওবা হলো এই যে, যেমন গুনাহর প্রতি ভালোবাসা ও আকর্ষণ ছিল ঐ রকমই তার প্রতি অন্তরে ঘৃণা জন্মে যাওয়া। যখন ঐ গুনাহর কথা স্মরণ হয়, তখন ক্ষমা প্রার্থনা করা। যখন কোন বান্দা তওবা করার জন্য দৃঢ় সংকল্প করে নেয় এবং তওবার ওপর অটল থাকে, তখন মহান আল্লাহ তার পূর্বের সমস্ত গুণাহ মাফ করে দেন।
ইমাম গাজজালী র. তওবায়ে নাসুহার জন্য তিনটি উপাদানের কথা বলেছেন। ঐ তিন উপাদানের সমন্বয় হচ্ছে খাঁটি তওবা। উক্ত বিষয়গুলো হচ্ছে-
১. তওবা সম্পর্কে ‘ইলম’ বা জ্ঞান থাকা। তওবাকারী গুনাহ সম্পর্কে জানবে এবং তা যে মাফ হতে পারে বা মহান আল্লাহ মাফ করতে পারেন তাও তার জানা থাকতে হবে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
(হে নবী,) বলে দাও, হে আমার বান্দারা যারা নিজের আত্মার ওপর জুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না৷ নিশ্চিতভাবেই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করে দেন৷ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু৷ (সূরা আল যুমার : ৫৩)
মহান আল্লাহ আরও বলেন,
وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ وَلَمْ يُصِرُّوا عَلَىٰ مَا فَعَلُوا وَهُمْ يَعْلَمُونَ
আর যারা কখনো কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা কোন গোনাহের কাজ করে নিজেদের ওপর জুলুম করে বসলে আবার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়ে তাঁর কাছে নিজেদের গোনাহ খাতার জন্য মাফ চায়- কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কে গোনাহ মাফ করতে পারেন এবং জেনে বুঝে নিজেদের কৃতকর্মের ওপর জোর দেয় না। (সূরা আলে ইমরান : ১৩৫)
২. তওবার সময় ব্যক্তির মানসিক অবস্থা, যা তার আবেগ অনুভূতির সাথে সম্পৃক্ত সে সম্পর্কে জানা থাকা।
ক. পাপ করার পর ব্যক্তির তীব্র দংশন, মানসিক আঘাত ও যাতনা তৈরি হবে। মনে হবে দুনিয়ায় তার সবকিছু থেকেও নেই। এ ধরনের কষ্ট, আঘাত ও মনোযাতনা তৈরি হবে। এর চিত্রায়ণে মহান আল্লাহ বলেন,
وَعَلَى الثَّلَاثَةِ الَّذِينَ خُلِّفُوا حَتَّىٰ إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنفُسُهُمْ وَظَنُّوا أَن لَّا مَلْجَأَ مِنَ اللَّهِ إِلَّا إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُوا ۚ إِنَّ اللَّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيم
আর যে তিনজনের ব্যাপার মুলতবি করে দেয়া হয়েছিল তাদেরকেও তিনি মাফ করে দিয়ছেন পৃথিবী তার সমগ্র ব্যাপকতা সত্ত্বেও যখন তাদের জন্য সংকীর্ণ হয়ে গেলো, তাদের নিজেদের প্রাণও তাদের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ালো এবং তারা জেনে নিল যে, আল্লাহর হাত থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর নিজের রহমতের আশ্রয় ছাড়া আর কোন আশ্রয়স্থল নেই, তখন আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের দিকে ফিরলেন যাতে তারা তার দিকে ফিরে আসে। অবশ্যি আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও করুণাময়। (সূরা আত তাওবা : ১১৮)
তাঁর অনুশোচনা এমন হবে সে নিজেই মহান আল্লাহর কাছে অনবরত মাফ চাইতে থাকবে। যেমন আদম আ. ও হাওয়া রা. গাছের ফল খেয়ে অনুশোচনা করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন:
قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ
তারা দু’জন বলে উঠলো : “হে আমাদের রব! আমরা নিজেদের ওপর জুলুম করেছি৷ এখন যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না করো, এবং আমাদের প্রতি রহম না করো, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো৷” (সূরা আল আরাফ : ২৩)
হুদ আ. যেমনিভাবে অত্যন্ত বিনয়সহকারে অসহায়ের মত কাকুতি-মিনতি করে অনুশোচনা করে বলেছিলেন, তেমনি বিনয় ও কাতরতার সাথে আবেগ-অনুভূতির মিশ্রণে তওবা করতে হবে। আল কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
قَالَ رَبِّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ أَنْ أَسْأَلَكَ مَا لَيْسَ لِي بِهِ عِلْمٌ ۖ وَإِلَّا تَغْفِرْ لِي وَتَرْحَمْنِي أَكُن مِّنَ الْخَاسِرِينَ
নূহ তখনই বললো, “হে আমার রব! যে জিনিসের ব্যাপারে আমার জ্ঞান নেই তা তোমার কাছে চাইবো- এ থেকে আমি তোমার কাছে পানাহ চাচ্ছি৷ যদি তুমি আমাকে মাফ না করো এবং আমার প্রতি রহমত না করো তাহলে আমি ধ্বংস হয়ে যাবো৷” (সূরা আল হুদ : ৪৭)
খ. সুদৃঢ় সঙ্কল্প গ্রহণ। অর্থাৎ তওবার প্রাক্কালে অত্যন্ত একনিষ্ঠ, দৃঢ় ও শক্তভাবে এমন ওয়াদা করা যাতে কোন অবস্থায় কোনোভাবেই আর ঐ পাপ করার সামান্যতম অনুভূতি আর তৈরি না হয়। তওবাকারী অনুশোচনা করবে এবং সংকল্পবদ্ধ হবে ভবিষ্যতে নতুন করে আর পাপাচার করবে না। এর পাশাপাশি সে তার এ সত্য তওবা কবুল হওয়া থেকে নিরাশ হবে না। এ ধরনের ব্যক্তির ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,
رَّبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا فِي نُفُوسِكُمْ ۚ إِن تَكُونُوا صَالِحِينَ فَإِنَّهُ كَانَ لِلْأَوَّابِينَ غَفُورًا
তোমাদের রব খুব ভালো করেই জানেন তোমাদের মনে কী আছে৷ যদি তোমরা সৎকর্মশীল হয়ে জীবন যাপন করো, তাহলে তিনি এমন লোকদের প্রতি ক্ষমাশীল যারা নিজেদের ভুলের ব্যাপারে সতর্ক হয়ে বন্দেগির নীতি অবলম্বন করার দিক ফিরে আসে। (সূরা বনি ইসরাইল : ২৫)
৩. বিশুদ্ধ তওবার কিছু বাস্তব পদক্ষেপ বা আমল করা অত্যাবশ্যক
ক. তাৎক্ষনিণ ঐ অন্যায় থেকে বিরত থাকা। কারণ ব্যক্তির মনে হতে পারে আচ্ছা যেহেতু অন্যায়টা শুরু করেই ফেলেছি তাহলে শেষ করি। এর পর তওবা করব। এতে কোনো ফায়দা হবে না। কারণ, সে তার নফস এর কাছে পরাজিত হয়েছে। তবে সে যদি তাৎক্ষণিক ঐ পাপা থেকে ফিরে আসতে পারে, তাহলে সে বরং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার মত সওয়াবের অধিকারী হবে। মহান আল্লাহ তার জন্য সেখান থেকে ফিরে আসার পথ প্রদর্শন করবেন বলে ওয়াদা করেছেন। তিনি বলেন:
وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا ۚ وَإِنَّ اللَّهَ لَمَعَ الْمُحْسِنِينَ
যারা আমার জন্য সংগ্রাম-সাধনা করবে তাদেরকে আমি আমার পথ দেখাবো। আর অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মশালীদেরই সাথে আছেন৷ (সূরা আল আনকাবুত : ৬৯)
খ. ইসতিগফার করা
অর্থাৎ মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। আন্তরিকভাবে ঠিকমত ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারলে মহান আল্লাহ অবশ্যই ক্ষমা করবেন। এ ওয়াদা আল-কুরআনের অনেক স্থানে বিদ্যমান। সূরা হুদের ৯০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَاسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ ۚ إِنَّ رَبِّي رَحِيمٌ وَدُودٌ
“দেখো, নিজেদের রবের কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁর দিকে ফিরে এসো। অবশ্যি আমার রব করুণাশীল এবং নিজের সৃষ্টিকে ভালোবাসেন।”
এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা সূরা আলে ইমরানের ১৩৩ নম্বর আয়াতে বলেন:
وَسَارِعُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ أُعِدَّتْ لِلْمُتَّقِينَ
দৌড়ে চলো তোমাদের রবের ক্ষমার পথে এবং সেই পথে যা পৃথিবী ও আকাশের সমান প্রশস্ত জান্নাতের দিকে চলে গেছে, যা এমন সব আল্লাহভীরু লোকদের জন্য তৈরি করা হয়েছে।
তিনি ক্ষমার ব্যাপারে সূরা আল হাদিদের ২১ নম্বর আয়াতে আরো বলেন:
سَابِقُوا إِلَىٰ مَغْفِرَةٍ مِّن رَّبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُهَا كَعَرْضِ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أُعِدَّتْ لِلَّذِينَ آمَنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ ۚ ذَٰلِكَ فَضْلُ اللَّهِ يُؤْتِيهِ مَن يَشَاءُ ۚ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ
দৌড়াও এবং একে অপরের চেয়ে অগ্রগামী হওয়ার চেষ্টা করো তোমার রবের মাগফিরাতের দিকে এবং সে জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি আসমান ও জমিনের মত। তা প্রস্তুত রাখা হয়েছে সে লোকদের জন্য যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলদের প্রতি ঈমান এনেছে। এটা আল্লাহর অনুগ্রহ। যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল।
গ. পরিবেশ এবং বন্ধুদের পরিবর্তন করা
অর্থাৎ যেসব বন্ধুর সাথে চলাফেরা করলে এবং যেসব পরিবেশে গেলে তওবাকারী আবারও অন্যায় কাজে লিপ্ত হতে পারে, সেসব স্থান এবং ব্যক্তি পরিত্যাগ করা। কারণ বন্ধু দুই প্রকার। একজন হাত ধরে জান্নাতে নিয়ে যাবে, আরেকজন জাহান্নামে নিয়ে যাবে। সে দিন বন্ধু বন্ধুর শত্রু হয়ে যাবে। তারা একে অন্যকে বলবে তুমিই আমাকে পথভ্রষ্ট করেছো। তবে সেদিন মুত্তাকি বন্ধু এ কাজ করবে না। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন,
الْأَخِلَّاءُ يَوْمَئِذٍ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ إِلَّا الْمُتَّقِينَ
যখন সে দিনটি আসবে তখন মুত্তাকিরা ছাড়া অবশিষ্ট সব বন্ধুই একে অপরের দুশমন হয়ে যাবে। (সূরা যুখরুফ : ৬৭)
অসৎ বন্ধুদের নিয়ে সেদিন মানুষের আফসোসের সীমা থাকবে না। মহান আল্লাহ বলেন:
وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَىٰ يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلًا﴾﴿يَا وَيْلَتَىٰ لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلَانًا خَلِيلًا﴾﴿لَّقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي ۗ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنسَانِ خَذُولًا
জালেমরা সেদিন নিজেদের হাত কামড়াতে থাকবে এবং বলতে থাকবে, “হায়! যদি আমি রাসূলের সহযোগী হতাম। হায়! আমার দুর্ভাগ্য, হায়! যদি আমি অমুক লোককে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করতাম তার প্ররোচনার কারণে আমার কাছে আসা উপদেশ আমি গ্রহণ করিনি মানুষের জন্য শয়তান বড়ই বিশ্বাসঘাতক প্রমাণিত হয়েছে। (সূরা আল ফুরকান: ২৭-২৯)
গ. ভালো কাজ করার জন্য মন্দ কাজের অনুসরণ করা। অর্থাৎ কোন মানুষ যখন অন্যায় এবং মন্দ কাজ করে তখন তা দেখে তার উল্টো কাজ করা। যেমন- ক) কোন ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে, তওবাকারী তাকে সম্মান ও মর্যাদা দান করবে। খ) কেউ মন্দ পত্রিকা পাঠ করে, সে কুরআন, হাদিস ও ইসলামী সাহিত্য পাঠ করবে। গ) কোন ব্যক্তি আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করে, তওবাকারী তা রক্ষা করার চেষ্টা করবে ঘ) কেউ গান-বাজনা এবং মন্দ আড্ডায় অংশগ্রহণ করে, তওবাকারী কোন উপকারী ইলমের দারসে অংশগ্রহণ করতে পারে।
ঘ) একমাত্র মহান আল্লাহর জন্য খালিস তওবা হতে হবে। কোন ভয়-ভীতি, অনিষ্ট এবং ক্ষতির আশঙ্কায় কোন অন্যায় থেকে বিরত থাকলে তা তওবা হিসেবে কবুল হবে না। যেমন কেউ পিতার অবাধ্য হলো এবং পিতা তার সন্তানকে সম্পদ থেকে বঞ্চিত করলো, তখন সে ব্যক্তি যদি অনুশোচনা করে তখন তা কবুল করা হবে না।
প্রাগুক্ত আলোচনার আলোকে এবং সামগ্রিকভাবে তওবার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত কিছু বিষয়ের অবগতি অত্যাবশ্যক। যেমন:
প্রথমত, প্রকৃতপক্ষে তওবা হচ্ছে কোন গোনাহের কারণে এ জন্য লজ্জিত হওয়া যে, তা আল্লাহর নাফরমানি। কোন গোনাহের কাজ স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর অথবা বদনামের কারণ অথবা আর্থিক ক্ষতির কারণ হওয়ায় তা থেকে বিরত থাকার সঙ্কল্প করা তওবার সংজ্ঞায় পড়ে না।
দ্বিতীয়ত, যখনই কেউ বুঝতে পারবে যে, তার দ্বারা আল্লাহর নাফরমানি হয়েছে, তার উচিত তৎক্ষণাৎ তওবা করা এবং যেভাবেই হোক অবিলম্বে তার ক্ষতিপূরণ করা কর্তব্য, তা এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয় ।
তৃতীয়ত, তওবা করে বারবার তা ভঙ্গ করা, তওবাকে খেলার বস্তু বানিয়ে নেয়া এবং যে গোনাহ থেকে তওবা করা হয়েছে বার বার তা করতে থাকা তওবা মিথ্যা হওয়ার প্রমাণ। কেননা, তওবার প্রাণসত্তা হচ্ছে কৃত গোনাহ সম্পর্কে লজ্জিত হওয়া কিন্তু বার বার তওবা ভঙ্গ করা প্রমাণ করে যে, তার মধ্যে লজ্জার অনুভূতি নেই। এ জন্য মহান আল্লাহ বলেছেন:
إِنَّمَا التَّوْبَةُ عَلَى اللَّهِ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السُّوءَ بِجَهَالَةٍ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٍ فَأُولَٰئِكَ يَتُوبُ اللَّهُ عَلَيْهِمْ ۗ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا﴾﴿وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّىٰ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ ۚ أُولَٰئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا
তবে এ কথা জেনে রাখো, আল্লাহর কাছে তওবা কবুল হওয়ার অধিকার একমাত্র তারাই লাভ করে যারা অজ্ঞতার কারণে কোন খারপ কাজ করে বসে এবং তারপর অতি দ্রুত তওবা করে । এ ধরনের লোকদের প্রতি আল্লাহ আবার তাঁর অনুগ্রহের দৃষ্টি নিবন্ধ করেন এবং আল্লাহ সমস্ত বিষয়ের খবর রাখেন, তিনি জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ। কিন্তু তওবা তাদের জন্য নয়, যারা খারাপ কাজ করে যেতেই থাকে, এমনকি তাদের কারো মৃত্যুর সময় এসে গেলে সে বলে, এখন আমি তওবা করলাম। অনুরূপভাবে তওবা তাদের জন্যও নয় যারা মৃত্যুর সময় পর্যন্ত কাফের থাকে। এমন সব লোকদের জন্য তো আমি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তৈরি করে রেখেছি। (সূরা আন নিসা : ১৭-১৮)
চতুর্থত, যে ব্যক্তি সরল মনে তওবা করে পুনরায় ঐ গোনাহ না করার সংকল্প করেছে মানবিক দুর্বলতার কারণে, যদি পুনরায় তার দ্বারা সেই গোনাহের পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে এ ক্ষেত্রে পূর্বের গোনাহ পুনরুজ্জীবিত হবে না, তবে পরবর্তী গোনাহের জন্য তার পুনরায় তওবা করা উচিত।
পঞ্চমত, যখনই গোনাহর কথা মনে পড়বে তখনই নতুন করে তওবা করা আবশ্যক নয়। কিন্তু তার প্রবৃত্তি যদি পূর্বের পাপময় জীবনের স্মৃতিচারণ করে আনন্দ পায়, তাহলে গোনাহের স্মৃতিচারণ তাকে আনন্দ দেয়ার পরিবর্তে লজ্জাবোধ সৃষ্টির কারণ না হওয়া পর্যন্ত তার বার বার তওবা করা উচিত। কারণ, যে ব্যক্তি সত্যিই আল্লাহর ভয়ে গোনাহ থেকে তওবা করেছে, সে অতীতে আল্লাহর নাফরমানি করেছে এই চিন্তা করে কখনো আনন্দ অনুভব করতে পারে না। তা থেকে মজা পাওয়া ও আনন্দ অনুভব করা প্রমাণ করে যে, তার মনে আল্লাহর ভয় শিকড় গাড়তে পারেনি।
আয়াতের নিম্নোক্ত অংশের ব্যাখ্যা
عَسَىٰ رَبُّكُمْ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ
এখানে এ কথা বলা হয়নি যে, তওবা করলে তোমাদের অবশ্যই মাফ করে দেয়া হবে। এবং তোমাদেরকে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে। বরং তাদের এই প্রত্যাশা দেয়া হয়েছে যে, যদি তোমরা সরল মনে তওবা করো তাহলে অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ তোমাদের সাথে এই আচরণ করবেন। এর অর্থ হলো, গোনাহগার বান্দার তওবা কবুল করা এবং তাকে শাস্তি দেয়ার পরিবর্তে জান্নাত দান করা আল্লাহর জন্য ওয়াজিব নয়। বরং তিনি যদি মাফ করে দেন এবং পুরস্কারও দেন তাহলে তা হবে সরাসরি তার দয়া ও মেহেরবানি। বান্দার তাঁর ক্ষমালাভের আশা অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু তওবা করলে ক্ষমা পাওয়া যাবে এই ভরসায় গোনাহ করা উচিত নয়। (তাফহিম)
يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ ۖ
মহান রব আখিরাতে তওবাকারী ব্যক্তিদের নবীদের এবং তাদের সাথে যারা থাকবেন তাদের কোনোভাবেই অপমান করবেন না। অর্থাৎ এ ধরনের নেক আমলকারী বান্দাদের উত্তম কার্যাবলির পুরস্কার নষ্ট করবেন না। কাফের মুনাফিকদের এ কথা বলার সুযোগ মোটেই দেবেন না যে, আল্লাহর বন্দেগি করে এসব লোক কী প্রতিদান লাভ করেছে? বরং লাঞ্ছনা, অপমান পতিত হবে বিদ্রোহী ও নাফরমানদের ভাগে। বিশ্বাসী ও অনুগতদের ভাগে তা পড়বে না। নবী করিম সা. এ অপমান থেকে বাঁচার জন্য মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছেন। বনু কিনানার একজন লোক বলেন, আমি মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল সা. এর পেছনে সালাত আদায় করেছিলাম, আমি তাঁকে দু‘আয় বলতে শুনেছিলাম: ” اللَّهُمَّ لَا تُخْزِنِي يَوْم الْقِيَامَة ”
হে আল্লাহ কিয়ামতের দিন আপনি আমাকে অপদস্থ করবেন না। (মুসনাদে আহমাদ)
পূর্বেই জানা গেছে মহান আল্লাহ মুমিনদের অপমান অপদস্থ করবেন না বরং তাদেরকে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে নূর দেয়া হবে, যা তাদের সামনে ও ডান পাশে ধাবিত হবে। আর অন্যরা অন্ধকারে থাকবে। এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ সূরা হাদিদের ১২ নম্বর আয়াতে বলেন:
يَوْمَ تَرَى الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ يَسْعَىٰ نُورُهُم بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِم بُشْرَاكُمُ الْيَوْمَ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا ۚ ذَٰلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ
যেদিন তোমরা ঈমানদার নারী ও পুরুষদের দেখবে, তাদের ‘নূর’ তাদের সামনে ও ডান দিকে দৌড়াচ্ছে৷ (তাদেরকে বলা হবে) “আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ৷” জান্নাতসমূহ থাকবে যার পাদদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারাসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। যেখানে তারা চিরকাল থাকবে। এটাই বড় সফলতা।
সুতরাং এ কথা স্পষ্ট হয় যে, ঈমানদারগণ যখন হাশরের ময়দান থেকে জান্নাতের দিকে যেতে থাকবেন তখনই তাদের আগে আগে ‘নূও’ অগ্রসর হওয়ার এই ঘটনা ঘটবে। সেখানে চারদিকে থাকবে নিকষ কালো অন্ধকার। যাদের জন্য দোজখের ফয়সালা হবে তারাই কেবল সেখানে অন্ধকারে ঠোকর খেতে থাকবে। আলো কেবল ঈমানদারদের সাথেই থাকবে। সেই আলোর সাহায্যে তারা পথ অতিক্রম করতে থাকবে।
সেদিন মুনাফিক নারী-পুরুষ আর্তনাদ করবে, অনুরোধ করবে একটু দাঁড়াও! আমরা তোমাদের আলোকচ্ছটায় তোমাদের সাথে যাই। তাদের এ আবেদন নিষ্ফল হয়ে যাবে। এ ব্যাপারে মহান রবের ঘোষণা:
يَوْمَ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ لِلَّذِينَ آمَنُوا انظُرُونَا نَقْتَبِسْ مِن نُّورِكُمْ قِيلَ ارْجِعُوا وَرَاءَكُمْ فَالْتَمِسُوا نُورًا فَضُرِبَ بَيْنَهُم بِسُورٍ لَّهُ بَابٌ بَاطِنُهُ فِيهِ الرَّحْمَةُ وَظَاهِرُهُ مِن قِبَلِهِ الْعَذَابُ
সেদিন মুনাফিক নারী-পুরুষের অবস্থা হবে এই যে, তারা মু’মিনদের বলবে, আমাদের প্রতি একটু লক্ষ কর যাতে তোমাদের ‘নূর’ থেকে আমরা কিছু উপকৃত হতে পারি৷ কিন্তু তাদের বলা হবে, পেছনে চলে যাও৷ অন্য কোথাও নিজেদের ‘নূর’ তালাশ কর৷ অতঃপর একটি প্রাচীর দিয়ে তাদের মাঝে আড়াল করে দেয়া হবে৷ তাতে একটি দরজা থাকবে৷ সে দরজার ভেতরে থাকবে রহমত আর বাইরে থাকবে আজাব। (সূরা আল হাদিদ : ১৩)
এই নাজুক পরিস্থিতিতে অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়ানো লোকদের আর্তনাদ ও বিলাপ শুনে শুনে ঈমানদারদের ওপর হয়তো ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে থাকবে এবং নিজেদের ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা স্মরণ করে তারাও আশঙ্কা করতে থাকবে যে, তাদের ‘নূও’ আবার ছিনিয়ে নেয়া না হয় এবং দুর্ভাগাদের মত তাদেরকেও অন্ধকারে হাতড়িয়ে মরতে না হয়। তাই তারা দোয়া করতে থাকবে, হে আমাদের রব, আমাদের অপরাধসমূহ ক্ষমা করে দাও এবং জান্নাতে না পৌঁছা পর্যন্ত আমাদের ‘নূও’কে অবশিষ্ট রাখ। ইবনে জারির হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাসের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, (رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا) এর অর্থ হচ্ছে, যতক্ষণ তারা সহি সালামতে পুলসিরাত অতিক্রম করে না যায় ততক্ষণ যেন তাদের নূর অবশিষ্ট থাকে এবং নিভে না যায়। তবে যারা ঈমানওয়ালা হবে আল্লাহর অসীম রহমতে তাদের নূর নিভে যাবে না। নবী করিম সা. তাঁর উম্মতদের ঠিকই চিনতে পারবেন এবং তাদের নূর তাদের সাথে জান্নাত পর্যন্ত যাবে। এ ব্যাপারে একটি হাদিস হচ্ছে:
وَأَعْرِفُهُمْ يُؤْتَوْنَ السُّجُود وَأَعْرِفهُمْ بِنُورِهِمْ يَسْعَى بَيْن أَيْدِيهمْ ” .
আমি সেখানে আমার উম্মতের নেককার লোকদের তাদের নূরের সাহায্যে চিনতে পারবো, যে নূর তাদের সামনে ডানেও বাঁয়ে দৌড়াতে থাকবে। (হাকেম, ইবনে আবী হাতেম, ইবনে মারদুইয়া)।
দয়াময় মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে তওবা নাসুহা নসিব করুন এবং পুলসিরাত অতিক্রমের সময় পর্যাপ্ত নূর দান করে সহজে জান্নাতে যাওয়ার তাওফিক দিন।
No comments
Thank You For your Comments.