ইসলামের দৃষ্টিতে সন্ত্রাস ও চরমপন্থা
আজ থেকে প্রায় ১৪০০ শত বছর আগে ইসলামের আবির্ভাব ঘটেছিল এমন এক পরিবেশে যখন মানুষের সার্বিক আচার-আচরণ পশুদের আচরণকে অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। সে যুগটি আখ্যায়িত হয়েছিল অন্ধকার যুগ হিসেবে। মানবাধিকারের বদলে পাশবিকতা ছিল যে সমাজের মূলমন্ত্র। অমানবিক ও পাশবিক যাবতীয় কাজ তৎকালীন সমাজে শ্রেষ্ঠত্ব ও কৌলিন্যের বিষয় ছিল। সে সময়ের অনাকাক্সিক্ষত কার্যকলাপের কথা মনে হলে গা শিউরে ওঠে। এমন একটি সমাজকে রাসূল (সা) তার নৈতিক আদর্শ, মহানুভবতা, সহনশীলতা, ত্যাগ-তিতিক্ষার মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। গড়ে তোলেন সর্বোত্তম একটি মানবীয় সমাজ।
চরমপন্থা শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো Extremism, যার অর্থ হলো Holding extreme views বা চরম মনোভাব পোষণকারী বা উগ্রপন্থী। এ শব্দটার ইংরেজি হলো Extremist যার অর্থ হলো Diehard fantic, militant vadical, terrorist, ultraconservative, zealot। অতএব চরমপন্থা সমার্থক অর্থবোধক শব্দ। সন্ত্রাস শব্দের অর্থ হলো অতিশয় ত্রাস, ভয়ের পরিবেশ। আর সন্ত্রাসবাদ হলো রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক কর্ম অবলম্বন। সন্ত্রাস শব্দটিকে নানা জন নানা অর্থে ব্যবহার করে থাকেন সে অর্থে স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রতিপক্ষ চরমপন্থা ও সন্ত্রাস হিসেবে যেমন আখ্যায়িত করে থাকেন ঠিক তেমনি স্বাধীনতাকামীরা আবার তাদের প্রতিপক্ষকে চরমপন্থা অবলম্বনকারী, সন্ত্রাস বিস্তারকারী অথবা মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন।১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে আরব রাষ্ট্রগুলোর স্বরাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রীদের এক সম্মেলনে সন্ত্রাসের নি¤œরূপ সংজ্ঞা দেয়া হয়। তাতে বলা হয়, সন্ত্রাস হলো ব্যক্তি বা সামষ্টিক অপরাধের মনোবৃত্তি হতে সংঘটিত নিষ্ঠুর কাজ বা কাজের হুমকি, তা যে লক্ষ্যেই হোক না কেন। তা দ্বারা মানুষের মনে ভয়ভীতি সঞ্চার করা হয় বা তাদেরকে কষ্টে ফেলার হুমকি দেয়া হয়, বা তাদের জীবন, স্বাধীনতা বা নিরাপত্তাকে ধ্বংসের মুখে ফেলা হয় বা পরিবেশকে ক্ষতির মুখে ফেলে দেয়া হয় বা সাধারণ জনগণের বা সরকারি সম্পত্তি ছিনতাই, জবর দখল, নষ্ট করা হয়। সম্মেলনে সন্ত্রাসের সংজ্ঞা এভাবেই দেয়া হয়েছে, সন্ত্রাস হল ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য হিংসাত্মক কাজ সংঘটিত করা অথবা এর হুমকি প্রদান করা। সন্ত্রাসীরা হত্যা, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, বিমান হাইজাক, বোমা হামলাসহ ইত্যাদি মারাত্মক অপরাধের কাজ করে। কূটনৈতিক, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, পুলিশ ও বিচারকরা সন্ত্রাসীদের দ্বারা হত্যা ও অপহরণের শিকার হন। সন্ত্রাস সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, “যখন সে শাসকের আসনে বসে, তখন পৃথিবীতে ফ্যাসাদ ছড়িয়ে দিতে ব্যাপৃত হয় এবং ফসল ও প্রাণিকুলকে ধ্বংস করে দিতে প্রবৃত্ত হয় অথচ আল্লাহ ফাসাদ ভালোবাসেন না।” পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন, “আল্লাহর সাথে দৃঢ় অঙ্গীকারে আবদ্ধ হওয়ার পর যারা তা ভেঙে দেয় এবং আল্লাহ সেসব সম্পর্ক দৃঢ় করার আদেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে ও পৃথিবীতে ফ্যাসাদ ব্যাপৃত করে তাদের ওপরই আল্লাহর অভিশাপ, তাদের জন্য রয়েছে নিকৃষ্ট ঠিকানা।
পাশ্চাত্য দেশ বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণে আগ্রহী নয়, কেননা যদি এর সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয় তবে তাদের পক্ষে হয়ত এর ইচ্ছামতো ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। সন্ত্রাস বা চরমপন্থা মানব ইতিহাসের মতোই পুরনো। পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম চরমপন্থার বিস্তার ঘটানো হয় উগ্রবাদী ইহুদি কর্তৃক। উগ্রবাদী ইহুদি ধার্মিকগণ তাদের ধর্মীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নেন। মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম সন্ত্রাসী কর্ম ছিল উগ্রপন্থী ইহুদি জিলটদের সন্ত্রাস। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী ও তার সমসাময়িক কালে রোমান সম্রাজ্যের অধীনে বসবাসরত উগ্রবাদী এসব ইহুদি নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্দ্র্যবোধ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আপসহীন ছিল। যে সকল ইহুদি রোমান রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করত বা সহাবস্থানের চিন্তা করত এবং তাদেরকে গুপ্ত হত্যা করত। তারা কখনই প্রতিপক্ষের হাতে জীবিত ধরা দিত না, প্রয়োজনে তারা আত্মহত্যা করত। এ জন্য তারা শিকারি বা ছুরি মানব হিসেবে প্রসিদ্ধ ছিল।
ফরাসি বিপ্লবের সময় (১৭৪৯-১৭৯৯) কতিপয় বিপ্লবী তাদের প্রতিপক্ষের বিষয়ে হিংসাত্মক বা চরমপন্থার আশ্রয় নিত। এ কালকে সন্ত্রাসের সময় বা জবমরড়হ ড়ভ ঃবৎৎড়ৎ বলা হয়। প্রথম দিকে সংঘটিত চরমúন্থী সন্ত্রাস ঘটনার মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংঘটিত সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করার মত। ১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধের পর পুনরায় উনিশ শতকে কুক্ল্যাক্স ক্ল্যান নামক একটি শেতাঙ্গ গ্রুপ কৃষ্ণাঙ্গ ও তাদের প্রতি সহানভূতিশীলদের ওপর বণবাদী সন্ত্রাস চালায়। মধ্যযুগে খ্রিস্টানদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসের অগণিত ঘটনা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করে। বিশেষত ধর্মীয় সংস্কার পাল্টা সংস্কারের যুগে ক্যাথিলক ও প্রটেস্টানদের মধ্যে অগণিত যুদ্ধ হত্যাকাণ্ড এমনকি যুদ্ধবহির্ভূত অসংখ্য সন্ত্রাস ও চরমপন্থী তৎপরতায় দেখা যায়। ধর্মীয় গোঁড়ামি ও রাজনৈতিক কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকারী হাজার হাজার লোককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে জার্মানিতে হিটলার ইতালিতে মুসোলিনি এবং সোভিয়েতে ইউনিয়নে জোসেফ স্ট্যালিন বিরোধী পক্ষকে দমনের নামে অবর্ণনীয় নারকীয় ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। ইহুদিরা পৃথিবীর ইতিহাসে জঘন্যতম সন্ত্রাস পরিচালনা করে ফিলিস্তিনে। পরাশক্তিসমূহের প্রত্যক্ষ মদদে সংঘটিত তাদের সন্ত্রাস পৃথিবীতে নজির সৃষ্টি করে রেখেছে। এ সন্ত্রাসের লক্ষ্য ছিল স্বীয়ভূমি থেকে তাদের বিতাড়িত করে, স্বীয় ভূখন্ড রক্ষায় তারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পৃথিবীর সকল মানদন্ডে বিচার করলে ইসরাইলি কর্মকান্ড সন্ত্রাস হিসেবে এবং ফিলিস্তিনিদের তৎপরতায় মুক্তি সংগ্রাম হিসেবে বিবেচিত।
অনুরূপভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উদ্ভব ঘটে উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে (ওজঅ ওৎরংয ৎবঢ়ঁনষরপধহ ধৎসু)। একইভাবে সত্তরের দশকে ক্যারিবিয়ান সাগরের পোর্টোরিকোতে ঋঅখঅঘ নামে স্বাধীনতা গ্রুপের উদ্ভব ঘটে আমেরিকান শাসনের বিরুদ্ধে। যারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য বোমা হামলার ঘটনা ঘটায়।
জিহাদ আরবি শব্দ। যাহা জুহুদ ধাতু থেকে এসেছে। যার শাব্দিক অর্থ চেষ্টা সাধনা করা। আর ইসলামের পরিভাষায় আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠা করার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা চালানো। জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বা আল্লাহর পথে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার সংজ্ঞা পবিত্র কুরআনের আলোচ্য আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি। ‘তোমরা ততক্ষণ লড়াই করতে থাক, যতক্ষণ না জমিন থেকে ফেতনা দূর হয় এবং সর্বত্র আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তাহারা দীন প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা থেকে বিরত হয় তবে জালিম ব্যতীত কারো প্রতি কঠোরতা আরোপ করা হয় না। অর্থাৎ যারা জিহাদের কাজ থেকে বিরত থাকবে তারা জালেম এবং তাদের ওপর আল্লাহ কঠোরতা আরোপ করবেন। পবিত্র কুরআনে আলোচ্য আয়াত থেকে পরিষ্কার বোঝা গেল আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বা জিহাদ করা মুসলমানদের ওপর অবশ্য কর্তব্য।
জিহাদ মানে দ্বীন প্রতিষ্ঠার নানাবিধ প্রচেষ্টা। এটা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, এ প্রচেষ্টা বক্তব্যের মাধ্যমে, লেখনীর মাধ্যমে, সেবামূলক কাজ, সমাজ সংস্কার, ধর্মীয় কাজ এমনকি চুড়ান্ত পর্যায়ে রাজনৈতিক তৎপরতা, সরকার পরিবর্তন ও যুদ্ধও হতে পারে। তবে এ যুদ্ধের কিছু নিয়মনীতি থাকবে। ইসলামে যেমন হঠকারিতার স্থান নেই, ঠিক তেমনি আল্লাহর নির্দেশ এড়িয়ে যাবার সুযোগও নেই। উল্লেখ্য যে, আল্লাহ মানুষকে তার প্রতিনিধি হিসেবে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আমি এ পৃথিবীতে খলিফা (প্রতিনিধি) প্রেরণ করতে ইচ্ছুক। আল্লাহর খলিফা বা প্রতিনিধি হিসেবে তার দায়িত্ব হলো এ পৃথিবীতে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা সাধনা বা জিহাদ করা। ইসলামে জিহাদ ফরজে আইন বা ব্যক্তিগত কর্তব্য। জিহাদের আসল উদ্দেশ্য হলো, মানুষের ওপর থেকে মানুষের প্রভুত্বকে উৎখাত করা সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, অত্যাচার, অবিচার, অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন ও নিষ্পেষণের মূলোৎপাটন করা। এর মাধ্যমে এদের ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি লাভ করা। রাসূল (সা)-এর ওপর অসংখ্য নির্যাতন হয়েছে কোথায়ও তিনি আগে আক্রমণ করেছেন এমন নজির নেই।
যতটুকু ভূমিকা ছিল তা নিতান্তই আত্মরক্ষামূলক ছিল। জিহাদের সাথে কোন অবস্থ’ায় সন্ত্রাসকে এক করে দেখার কোন সুযোগ নেই কেননা জিহাদ হলো প্রতিরক্ষার জন্য এবং সন্ত্রাস নির্মূল করে স্থায়ীভাবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার জন্য।
ইসলাম প্রতিটি মানুষের জান মাল ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তা দানকে অপরিহার্য করেছে। ইসলামে মানুষের প্রাণ ও রক্ত পবিত্র এবং সম্মানার্হ। বিদায় হজের সময় আরাফাতের ময়দানে ভাষণ দিতে গিয়ে আল্লাহর নবী মুহাম্মদ (সা) বলেছিলেন, তোমাদের একের জীবন ও সম্পদ অপরের জন্য নিষিদ্ধ। জাহেলি যুগের সমস্ত খুনের বদলার দাবি রহিত করা হলো। সর্বপ্রথম আমি আমর বিন রবিয়ার খুনের দাবি রহিত করলাম। ইচ্ছাকৃত হত্যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আমার পরে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব পরিত্যাগ করে কাফেরসুলভ জীবন গ্রহণ করে একে অপরের গলা কাটতে শুরু করে দিও না। কাউকে রাষ্ট্রীয়, জাতীয় বা সামরিক স্বার্থ ব্যতীত হত্যা করা পৈশাচিক ও ঘৃণ্য কাজ।
ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক কেবলমাত্র অন্য কোন ব্যক্তিকে হত্যা করা যে নিষিদ্ধ তা নয় বরং নিজেকে বা আত্মহত্যা করাও নিষিদ্ধ। কোন অবস্থায় নিজেকে ধ্বংস করা যাবে না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেন, তিনি মুমিনদের জান ও মালকে বেহেশতের বিনিময়ে খরিদ করে নিয়েছেন। যেহেতু মুমিনের জান ও মালকে আল্লাহ কিনে নিয়েছেন অতএব তিনি এর মালিক। আল্লাহর মালিকানাধীন বস্তু বিনষ্টের অধিকার বান্দার থাকতে পারে না। আত্মহত্যা নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের বক্তব্য নি¤œরূপ পথ- পবিত্র কুরআনের সূরায়ে নিসায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নিজেদেরকে হত্যা করো না।’ সূরায়ে বাকারায় আল্লাহ আরো বলেন, ‘তোমরা নিজেদের জীবনকে ধ্বংসের সম্মুখীন কর না।’ সূরা নিসায় আরো বলা হয়েছে, তোমরা নিজেদেরকে হত্যা কর না। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের ওপর দয়ালু। পবিত্র কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াত তিনটি থেকে আত্মহত্যা নিষিদ্ধ হওয়া সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যেখানে কোনো ধরনের অস্পষ্টতা নেই।
রাসূল (সা)-এর হাদিস থেকে আত্মহত্যার নিষিদ্ধতার বিষয়টি আরো বেশি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। এ ধরনের লোকেরা যে চিরস্থায়ী জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করবে সে সম্পর্কে মহানবী (সা) বলেন,
১. যে ব্যক্তি পাহাড়ের ওপর থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করবে, দোজখে বসেও সে অনবরত উচ্চ স্থান থেকে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। আর যে ব্যক্তি বিষপানে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামের মধ্যে বসেও অনন্তকাল বিষপান করতে থাকবে। আর যে ব্যক্তি কোন লোহার অস্ত্র দিয়ে নিজেকে হত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে বসে অনন্তকাল ধরে সেই অস্ত্র দিয়ে নিজেকে কোপাতে থাকবে।
২. যে ব্যক্তি নিজেকে শ্বাসরুদ্ধ করে (আত্মহত্যা করবে) সে জাহান্নামের মধ্যে নিজের শ্বাসরুদ্ধ করবে। আর যে নিজেকে আঘাত করবে (আত্মহত্যা করবে) সে জাহান্নামেও নিজেকে আঘাত করবে। তিনি আরো বলেন,
৩. তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক ব্যক্তি আহত হয়ে কষ্ট পাচ্ছিল। তাই সে একখানা ছুরি দ্বারা নিজের দেহে আঘাত করল, ফলে রক্তপাত হয়ে সে মারা গেল। তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার বান্দা আমাকে ডিঙিয়ে নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি তার জান্নাত হারাম করে দিলাম।
চরমপন্থীরা ভুল পথে পরিচালিত হওয়ার পেছনে যে সব কারণগুলো রয়েছে তা নি¤œরূপ- ক. গোঁড়া মনোভাব, খ. সমন্বিত জ্ঞানের বা ব্যাপক জ্ঞানের অভাব, গ. অহঙ্কার, ঘ. বক্র স্বভাব ও চিন্তাÑ এ ধরনের লোকেরা খুবই অপরিণামদর্শী হয়ে থাকে। তাদের বক্র চিন্তার কারণে তারা যেমন নিজেদের দুনিয়া ও আখেরাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে ঠিক তেমনি ইসলামী জীবনব্যবস্থাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে তোলে। এ শ্রেণীর লোকেরা নিজেদেরকে একমাত্র আল্লাহর খাস বান্দা বলে মনে করে, যা তাদের অহঙ্কারের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে দেয়, ফলে তারা তাদের মত যারা চলতে পারে না তাদেরকে কাফের বলে মনে করে এবং তাদেরকে হত্যা করা সর্বপ্রথম ও সর্বপ্রধান কাজ বলে মনে করে। এ ধরনের অহঙ্কার ও একপেশে মানসিকতা পরিহারের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা) কঠোর ভাষায় তাগিদ দিয়েছেন। ‘যখন কেউ বলবে যে, লোকজন ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, সে ব্যক্তি নিজকেই ধ্বংস করলো।
ঈমানদার ব্যক্তিকে কাফির বলা এক ধরনের ফিতনার সৃষ্টি করে যা সামাজিক অশান্তি ও বিপর্যয়ের কারণ। এর বিষময় ফল সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত তার দিকে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। ফিতনা বা বিপর্যয়ের মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কুরআন মজিদে বলেছেন, ‘ফিতনা বা বিপর্যয় হত্যার চেয়েও জঘন্য অপরাধ’। একই প্রসঙ্গে আল্লাহর নবী (সা) বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তি তার ভাইকে কাফির বলে, তবে এ কথা তাদের দু’জনের ওপর বর্তাবে। যদি তার ভাই সত্যিকার কাফির হয় তবে তো ঠিক অন্যথায় কাফির আখ্যায়িতকারীর ওপরই কুফর প্রযোজ্য হবে।
রাসূল (সা)-এর জীবন ছিল সহনশীলতা ও ক্ষমার এক অনুপম আদর্শ। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কখনো তিনি কাউকে আঘাত করেননি, কখনো কটু কথা বলেননি। কোন বিষয়ে তার অপছন্দ হলে বিভিন্ন সময়ে তাঁর মুখমন্ডল লাল হয়ে যেত কিন্তু কখনো তাঁকে দেখা যেত না কাউকে কোন ধরনের কটু কথা বলতে।
তিনি ছিলেন সত্যিই বিশ্ববাসীর জন্য আল্লাহর রহমত ও দয়ার সাগর। তাঁরই হাদিসের ভাবানুবাদ করে কবি বলেছেন, কারো মনে তুমি দিও না আঘাত সে আঘাত গিয়ে লাগে কাবার ঘরে। ‘ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সর্বক্ষেত্রে সকল পর্যায়ের মানুষের সাথে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ মাত্রার ঔদার্যের ও মহানুভবতার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক সৃষ্টি ইসলামের একটি সার্বজনীন নীতি। তাই ক্ষমাধর্মের প্রতিই ইসলামের সর্বাধিক অনুপ্রেরণা লক্ষ্য করা যায়। যতক্ষণ না তদ্বারা অন্য কারো হক বিনষ্ট হয়, কিংবা বাতিল শক্তি পৃথিবীতে নৈরাজ্য ও অরাজকতা সৃষ্টির কোন প্রকার আশ্রয় প্রশ্রয় লাভ করে। কিংবা এর অপব্যবহারের মাধ্যমে মানবতার ভয়াবহ সমূহ বিনাশ সাধনের কোন পরিস্থিতি পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ, অবাধে অন্যায় অবিচার, অনাচার, পাপাচার, নৈরাজ্য ও ধ্বংস সাধনে লিপ্ত মানবরূপী হিংস্র পশুদের সাথে আপস করার মানসিকতাকে কোনভাবেই মহানুভবতা বলা যায় না, তা হচ্ছে নিছক কাপুরুষতা, ভীরুতা, আত্মগ্লানি ও সত্যের অবমাননা।
অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারকে শক্তি ও ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে দূরীভূত করার মাধ্যমে স্পল্পসংখ্যক জালেমের হস্ত ও কণ্ঠ স্তব্ধ করার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ মজলুমের মুখে হাসি ফোটানো অবশ্যই মহৎ কাজ। রাসূল (সা)-কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অন্যায়ের জবাব ন্যায়ের মাধ্যমে দানের কথা বলেছেন। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ভালো ও মন্দ সমান নয়, আর আপনি মন্দের জবাব ভালোর মাধ্যমে দিন।
তখন আপনি দেখবেন এ পন্থায় আপনার পরম শত্রুরাও পরম বন্ধুতে পরিণত হয়ে গেছে। এ আয়াতের বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে আল্লাহর নবীর (সা) জীবনে। তিনি আজীবন মন্দের জবাব দিয়েছেন উত্তম পন্থায়। এ কারণে অমুসলিমরা দলে দলে তার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করতে দেখা গেছে। তাঁকে হত্যা করতে এসে তরবারি রাসূলের (সা) পদতলে লুটিয়ে দেন।
যেখানে আল্লাহর রাসূল (সা) তাঁর প্রাণের শত্রুকে অকাতরে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, তার সাথে সাথে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে তাদের প্রতি ক্ষমাসুন্দর আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন একইসঙ্গে চরমপন্থা ও কঠোর আচরণ সম্পর্কে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। অতএব তার অনুসারী হিসেবে কারো সাথে কঠোর ব্যবহার করার সুযোগ আমাদের কোথায়?
মানবজাতির ইতিহাসে চরমপন্থী দলের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। প্রাচীন যুগ থেকে ইহুদি উগ্রবাদী ধার্মিকগণ, ধমীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন। মানব ইতিহাসের প্রাচীন যুগের প্রসিদ্ধতম সন্ত্রাসী কর্ম ছিল উগ্রপন্থী ইহুদি জিলটদের সন্ত্রাস। খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী ও তার পরবর্তী সময়ে রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে বসবাসরত উগ্রপন্থী এ সকল ইহুদি নিজেদের ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আপসহীন ছিল। সে সকল ইহুদি রোমান রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করত বা সহাবস্থানের চিন্তা করত এরা তাদেরকে গুপ্ত হত্যা করত। এ জন্য এরা ছুরিমানব হিসেবে পরিচিত ছিল। এরা এতখানি চরমপন্থী ছিল যে, তারা প্রয়োজনে আত্মহত্যা করত কিন্তু প্রতিপক্ষের হাতে জীবিত ধরা দিত না। তাদের উওরসূরি এ ইহুদি জাতি কিভাবে ফিলিস্তিনিদের ভূখন্ডকে অন্যায়ভাবে দখল করে কয়েক যুগব্যাপী পাখি শিকারের ন্যায় নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে তা বিশ্ব বিবেক দেখছে।
মধ্যযুগে খ্রিষ্টানদের মধ্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে সন্ত্রাসের অগণিত ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করি। পোপ ও স¤্রাটের দ্বন্দ্ব সংঘাতের ফলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ইতিহাসে এ সময়কে অরাজনৈতিক যুগ বলা হয়। অন্যদিকে এ যুগটি অন্ধকার যুগ হিসেবেও খ্যাত। এ সময়ে রাজনীতি, ক্ষমতা ও ধর্মীয় উন্মাদনা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানে চর্চারত প্রায় ৩৫ হাজার লোককে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করার কথা ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়। এ সময়ের ক্যাথলিক ও পোটেস্টানদের মধ্যে অগণিত যুদ্ধ ও যুদ্ধবহির্ভূত সন্ত্রাসের অসংখ্য ঘটনা ঘটে।
১৯৬০ সালের দিকে আরেকটি চরমপন্থী আন্দোলনের ঢেউয়ের কথা ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি। এসময় সন্ত্রাসবাদী গ্রুপগুলোর মধ্যে ইতালির রেড ব্রিগেড এবং জার্মানির রেড আর্মি অন্যতম। ইতালির মুসোলিনি ও জার্মানির হিটলারের ফ্যাসিবাদী ও সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের কথা কে না জানে।
ইসলামের ইতিহাসে প্রথম চরমপন্থী দল হিসেবে খারেজি সম্প্রদায়ের আবির্ভাব ঘটে। হযরত ওসমান (রা) এর শাহাদতের ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ দলের আগমন ঘটে। হযরত আলী (রা) ও আমিওে মোয়াবিয়ার (রা) মধ্যে সংঘটিত সিফফিনের যুদ্ধে ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটলে হযরত আলী সালিসির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করলে তারই অনুসারীদের মধ্য থেকে চরমপন্থী একটি দল বেরিয় যায়। এদেরকে খারেজি বা দলত্যাগী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এরা ছিল ইসলামের দ্বিতীয় যুগের মানুষ। যারা রাসূল (সা)-এর ইন্তেকালের পরই ইসলাম গ্রহণ করে। এদের প্রায় সকলেই ছিল যুবক।
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি ইসলাম মানবতার ধর্ম, যার মূলভিত্তি সহনশীলতা, ভালোবাসা ও ক্ষমা। কোন ব্যক্তির বক্তব্য ইসলামের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পাবে না। প্রাধান্য পাবে কেবল কুরআন ও হাদিস বিশেষত মুহাম্মদ (সা) এর কৃতকর্ম। এ থেকে আমরা দেখতে পাই ইসলামে চরমপন্থার কোনো স্থান নেই।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়
No comments
Thank You For your Comments.