আমরা কি চাই? কেন চাই? কিভাবে চাই?
মানুষকে দেয়া হয়েছে বিবেক-বুদ্ধি তথা ভালো-মন্দ যাচাইয়ের বিচার করার ক্ষমতা। তাকে দেয়া হয়েছে চিন্তা ও কর্মের স্বাধীনতা। সুতরাং মুক্ত ও বন্ধনহীন জীবনে মানুষ যদি বিবেক ও যুক্তিবোধের দ্বারা পরিচালিত হয় তাহলেই মানুষকে অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে অধিকতর মর্যাদা সম্পন্ন বলা যায়।
প্রতিটি সৃষ্টিকর্মের পিছনে থাকে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য। এক সুমহান উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আর তা হলো জীবনে মানুষ আল্লাহর প্রতিনিধির ভূমিকা পালন করবে। আল্লাহর পক্ষ থেকে মহান দায়িত্ব নিয়ে দুনিয়ায় আবির্ভূত হওয়ার কারণেই মানুষকে এই মর্যাদায় সমাসীন করা হয়েছে। কিন্তু লাগামহীন স্বাধীনতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে সে যদি বিবেকের সীমা অতিক্রম করে বিচ্যুত হয় তার মহান দায়িত্ব পালন থেকে, তখন তার মর্যাদা হয় ভূলুণ্ঠিত। কোরানের ভাষায়, “এরা হচ্ছে পশুর সমতুল্য বরং তার চেয়েও নিকৃষ্ট”।
এই পৃথিবীর আমরা কেউই স্থায়ী বাসিন্দা নই। এখানে চলছে জন্ম মৃত্যুর নিরন্তর খেলা। দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়। মৃত্যুর পরে মানুষকে প্রবেশ করতে হবে আখেরাত নামক এক অনন্ত জীবনে। সেখানে প্রতিটি মানুষকে তার কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। মহান আল্লাহ তায়ালা দুনিয়ার জীবনে মানুষের সকল কর্মকাণ্ড রেকর্ডের ব্যবস্থা করেছেন এবং সেদিন উপস্থাপন করা হবে। পার্থিব জীবনে যারা সঠিকভাবে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব পালন করবে তথা তাঁর নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালনা করবে তাদের জন্য রয়েছে পুরষ্কার। আর যারা খোদায়ী বিধান লঙ্ঘন করে সমাজ জীবনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে তাদের জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি, এবং দাউ দাউ করে জ্বলা জাহান্নামের ভয়াবহ আযাবের দুঃসংবাদ। এযাবৎকালের এ পৃথিবীতে মানুষের সাময়িক আসা-যাওয়ার যে বিচিত্র মহড়া চলছে তা চিন্তাশীল প্রতিটি মানুষকেই ভাবিয়ে তোলে। সুতরাং মানব জীবনের গন্তব্যস্থল সম্পর্কে যার সঠিক উপলব্ধি তাকে অবশ্যই আল্লাহর নির্দেশিত পথে জীবন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে খোদায়ী বিধান মানুষ কিভাবে মেনে চলবে? কিভাবে পালন করবে প্রতিনিধিত্বের দায়িত্ব? দুনিয়ার এই পরিমণ্ডলে তার ভূমিকাই বা কি হবে?
এ সকল প্রশ্নের জবাব দিয়ে আল্লাহ মানুষের জন্য পাঠিয়েছেন একটি পূর্ণাঙ্গ ও নির্ভুল জীবন বিধান। সেই বিধান বা গাইড বুকের নাম, আল কুরআন। আল্লাহ শুধু গাইডবুক দিয়েই ক্ষান্ত হননি, কিভাবে সেই গাইডবুক অনুসরণ করে জীবনের কঠিন ও বিপদ সংকুল পথ অতিক্রম করতে হবে তার বাস্তব নমুনা পেশ করার জন্য প্রেরণ করেছেন পথ প্রদর্শক রাসূল (সাঃ)-কে। যার সম্পর্কে আল্লাহর ঘোষনা, “তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের চরিত্রের মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ”। (সূরা আল আহযাব-২১)
আল্লাহ প্রদত্ত এবং রাসূল (সা) প্রদর্শিত জীবন বিধানের নামই ইসলাম। মানব জাতির একমাত্র নির্ভুল এবং পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। মানবতার একমাত্র মুক্তির সনদ। ইসলাম প্রচলিত অর্থে নিছক কোন ধর্মের নাম নয়; বরং মানুষের জন্মের পর দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত অর্থাৎ ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডল, আন্তর্জাতিক পরিসরসহ জাগতিক সকল সমস্যার সমাধান, জীবন জিজ্ঞাসার জবাব এবং আখেরাতে মুক্তির একমাত্র নির্ভরযোগ্য ব্যবস্থা হল ইসলাম।
সমগ্র সৃষ্টি জগতই মহান আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি নিরঙ্কুশ ও সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। তিনি জীবন মৃত্যুর অধিকর্তা, রিজিকদাতা, বিধানদাতা এবং মহাবিচারক। সৃষ্টির ইবাদত কেবল মাত্র তাঁরই প্রাপ্য। কীট-পতঙ্গ থেকে শুরু করে বিশ্ব জগতের প্রতিটি সৃষ্টি তাঁর নির্দেশ মেনে চলে। তার অসীম ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণের কারণে গোটা মহাবিশ্বের পরিচালনায় কোন বিশৃঙ্খলা নেই। “মহান প্রভুর অপরূপ সৃষ্টিতে তুমি কোন অসঙ্গতি খুঁজে পাবে না। তোমার দৃষ্টি প্রসারিত করে দেখ। কোন অসঙ্গতি আছে কি? তোমার চোখ ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসবে (আল কুরআন)।
শুধুমাত্র আল্লাহকে প্রভু, মুহাম্মদ (সা)-কে রাসূল এবং আল কুরআনকে ধর্মগ্রন্থ বলে স্বীকার করার নামই মুসলমান নয়। মূলত মুসলমান হচ্ছেন তিনিই যিনি আল্লাহর রঙে নিজেকে রাঙিয়েছেন, দুনিয়ার অন্য যে কোন কিছুর চাইতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকে প্রাধান্য দিয়েছেন আখেরাতের জীবনের প্রকৃত মঞ্জিল নির্ধারণ করেছেন, অহরহ মানুষকে ডাকছেন সত্য ও সুন্দরের দিকে। “আর তোমরা হচ্ছো সর্বোত্তম জাতি, তোমরা মানুষকে ন্যায়ের দিকে ডাকবে এবং অন্যায় থেকে বিরত রাখবে, আর কেবল মাত্র আল্লাহর উপরই ঈমান রেখে চলবে। (সূরা আলে ইমরান-১১০)।
আল্লাহর নিয়ম লঙ্ঘন করাই দুনিয়ার জীবনে মানুষের বিপর্যয়ের মূল কারণ। আর এই পথভোলা, আত্মবিস্মৃত মানবতাকে সঠিক পথের দিশা দেখানোর দায়িত্ব প্রত্যেক মুসলমানের উপরই বর্তায়। আল্লাহর বিধান মেনে চলার দিকে মানব সমাজকে আহ্বান জানানো এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ণ অনুশীলনের মাধ্যমে মানবতার কল্যাণ নিশ্চিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোই মুসলমানদের মৌলিক দায়িত্ব। মুসলিম জাতি এ দায়িত্ব যতদিন পালন করছে ততদিন মানুষ হিসেবে তারা ছিল মর্যাদার আসনে সমাসীন। জাতি হিসেবে ছিল বিশ্বের বুকে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী।
শান্তির আশায় মানুষ যে মানবিক মতবাদের দ্বারস্থ হচ্ছে মানবতার মুক্তি সাধনে তা ব্যর্থ হয়েছে চরমভাবে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার, নবতর প্রযুক্তির উদ্ভাবন পৃথিবীকে এনে দিয়েছে মানুষের হাতের মুঠোয়। মানুষের নিয়ন্ত্রণ বলয় সম্প্রসারিত হচ্ছে পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে। কিন্তু শান্তির শ্বেত পায়রা এখনো ধরতে পারেনি মানুষ। আবিষ্কার করতে পারেনি শান্তির প্রক্রিয়া। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ তথাকথিত স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নামে অসাম্য উচ্ছৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে। সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চেতনা জাতিতে জাতিতে হিংসা-বিদ্বেষ, দ্বন্দ্ব ও কলহের জন্ম দিয়েছে। সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ তথা সমাজতন্ত্র শান্তি ও সাম্যের নামে বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে পাশবিক জিন্দানে বন্দী করে অবশেষে ইতিহাসের সর্বাধিক ঘৃণিত ও বিপর্যস্ত মতবাদ হিসেবে পৃথিবীর বুক থেকে চির বিদায় নিয়েছে। নয়া বিশ্বব্যবস্থা (New World Order) নামে পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত আজকের বিশ্বে মানবাধিকারের নামে মানবতা লাঞ্ছিত হচ্ছে দেশেদেশে। পৃথিবীর বাতাস ভারী হয়ে উঠছে নির্যাতিত মানুষের করুণ আর্তনাদ আর বারুদের গন্ধে। বিশ্বের ঘোষিত মোড়লরা গণতন্ত্রের লেবাছে পৃষ্ঠপোষকতা করে যাচ্ছে মানবতার কসাইদের। বিশ্বের কোটি কোটি শিশু যখন ক্ষুধার্ত অবস্থায় বিছানায় ঘুমাতে যায়, তখন অস্ত্র প্রতিযোগিতায় ব্যয় হচ্ছে কোটি কোটি ডলার। পারমাণবিক যুদ্ধের অশনি সংকেতে আতঙ্কিত আজ বিশ্ব মানবতা। এসবই মানবিক মতবাদের ব্যর্থতার সুস্পষ্ট স্মারক।
বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় জন্মভূমি। এদেশের শতকরা ৮৯.৭ ভাগ মানুষ মুসলমান। আমাদের রয়েছে দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস-ঐতিহ্য। অন্যায় আর অসত্যের কাছে এদেশের মানুষ কখনো। মাথা নত করেনি। বারবার আধিপত্যবাদী শক্তি এদেশের ওপর তাদের অশুভ তাবা বিস্তারের প্রয়াস পেয়েছে। এদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করতে চেয়েছে কিন্তু এদেশের সংগ্রামী মানুষেরা বারবার এদের প্রতিহত করেন এবং আমাদের জন্য তৈরী করেন বসবাস উপযোগী চমৎকার এক আবাসস্থল।
স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সকল দিকে শুরু করে এক ধূসর যাত্রা। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতির পাশাপাশি দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অসাম্য, নির্বিচারে নির্যাতন তথা এক ব্যাপক অরাজকতা জাতিকে ধ্বংশের মুখে ঠেলে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন এক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য ষড়যন্ত্র করা হয়। ইসলাম ও ইসলামী প্রতিষ্ঠানসমূহকে বিতর্কিত করার এক সর্বনাশী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এদেশের মাটি ও মানুষের শিকড়লব্ধ সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে বিজাতীয় মঙ্গল-সংস্কৃতির চর্চাকে আমদানি করা হয়। এভাবে জাতিকে পরিচয়ের সংকটে নিপতিত করা হয়। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ, একদলীয় শাসন কায়েমের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিশেষ মহলের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন আমাদের জাতীয় রাজনৈতিক জীবনকে চরম সংকটপূর্ণ করে তোলে। অর্থনৈতিক অঙ্গনেও “উলট-পালট করে দে মা লুটে পুটে খাই” দর্শন আসন গেড়ে বসে। একদিকে বিপুল জনসংখ্যা চরম দারিদ্র সীমার নীচে অবস্থান করে মানববেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়। অপরদিকে মুষ্টিমেয় সুবিধাবাদী গোষ্ঠী আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়ে যায়। সিংহভাগ সম্পদ জমা হয় নতুন বাঙ্গালী দাউদ ইস্পাহানীদের হাতে।
আসলে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পর্কে ভরপুর আমাদের দেশটির কেবল মাত্র বিপুল জনসংখ্যা অশিক্ষা কিংবা দারিদ্র মূল সমস্যা নয়। আমাদের সমস্যা অন্যত্র। অন্য একটি মৌলিক প্রশ্নের উপর নিহিত। আমাদের সম্পদের অভাব নেই। কিন্তু অভাব রয়েছে সৎ, যোগ্য ও খোদাভীরু মানুষের। যারা জাতীয় জীবন ও সম্পদকে আমানত জ্ঞান করে যথার্থ উন্নয়নে কাজ করবেন।
সত্য বলতে, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় যত পরিবর্তন সাধন করা হোক না কেন সৎ, আদর্শবাদী ও খোদাভীরু নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত না হলে কোন পরিবর্তনই কাঙ্খিত ফল দেবেনা। কিন্তু এই কাক্সিক্ষত মানুষ তৈরী করতে পারে দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলো। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষাঙ্গণগুলো জাতীয় নেতৃত্ব তৈরীর সেই কাঙ্খিত মান অর্জনে কি সহায়ক? এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান অবস্থার প্রতি নজর দেয়া যাক।
আমাদের শিক্ষাঙ্গনে চলছে নৈরাজ্য। স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোতে সন্ত্রাসের যে কালো থাবার বিস্তার হয়েছিল তা থেকে আজও মুক্ত হতে পারেনি আমাদের শিক্ষাঙ্গন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ছাড়া, আদর্শবর্জিত আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা আদর্শ মানুষ উপহার দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
নিজস্ব সামাজিক মুল্যবোধের চর্চা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও ঐতিহ্য দেশের শিক্ষানীতি এবং শিক্ষাকারিকুলামে প্রতিফলিত না হওয়ায় আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা স্বাধীন চিন্তার অধিকারী প্রকৃত দেশপ্রেমিক নাগরিক তৈরী করতে পারছে না। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতার নামে এমন এক শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে যার কারণে একজন ছাত্র বাহ্যিকরূপে এদেশের মানুষ থাকলেও চিন্তাচেতনায় হচ্ছে পাশ্চাত্যের ধ্যান-ধারণার অধিকারী। এভাবে কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে পাশ্চাত্যের জড়বাদী সভ্যতার কোলে। অথচ আদর্শিক দেওলিয়াত্বের শিকার পাশ্চাত্য সমাজ আজ নানা সামাজিক জটিলতার বিকাশ। যার রেখা যাচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা, সেই সাথে এক সবংগ্রাসী হতাশা। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, মাদকদ্রব্যের মরণনেশা যার অবশ্যাম্ভাবী ফল।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা নানাবিধ সমস্যায় পরিপূর্ণ। পরিকল্পনাহীন শিক্ষাপদ্ধতি আজ উৎপাদনশীল নাগরিক তৈরী করতে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। কর্মমুখী শিক্ষা না থাকায় বেকারত্বের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চ শিক্ষাকে দিন দিন করছে মূল্যহীন। শিক্ষা উপকরণের স্রমবর্ধমান মূল্য শিক্ষাকে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নাগালের বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা নামে ধর্মীয় শিক্ষার এমন একটি রূপ চালু রাখা হয়েছে যা না ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঠিক রূপায়নের সক্ষম শিক্ষার্থী তৈরী করছে, না আধুনিক পরিস্থিতির সাথে সামঞ্জস্যশীল মানুষ তৈরী করতে পারছে।
সন্ত্রাসে জর্জরিত আমাদের শিক্ষাঙ্গনে আজ শিক্ষার পরিবেশ নেই। মানুষ গড়ার আঙ্গিনায় মানুষ হবার পরিবেশ আজ মেধাহীন সন্ত্রাস-নির্ভর ছাত্র নেতৃত্বের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। লেজুর বৃত্তির ছাত্র রাজনীতি জাতির সবচেয়ে মেধাবী অংশটিকে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় ভ্রাতৃত্ব, ভালবাসা, দেশপ্রেম, নৈতিক মূল্যবোধে একজন শিক্ষার্থীর মন-মগজ, চিন্তা-চেতনাকে উজ্জীবিত করতে পারছে না।
আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনেও চলছে চরম দেউলিয়াত্ব। চলছে সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতির চর্চা। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সংস্কৃতির নামে পাশ্চাত্যের বিকৃত সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসারের মাধ্যমে আমাদের যুব চরিত্র ধ্বংসের সকল আয়োজন সম্পন্ন করা হয়েছে। শিক্ষা চিরন্তনের নামে অগ্নিপুজার নব্য সংস্করণ চালুর মাধ্যমে এদেশের তৌহিদী সংস্কৃতির ভিতকে উপড়ে ফেলার ষড়যন্ত্রকে চূড়ান্ত রূপ দেয়া হয়েছে। ব্যক্তিপূজা আর অত্যাচারের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নিক্ষেপ করা হচ্ছে অন্ধকারের গোলক ধাঁধায়। ক্ষমতাসীনরা মুখে ইসলামের কথা বলছেন আর অপরদিকে তথাকথিত চিত্তবিনোদন আর মুক্তবুদ্ধির চর্চার নামে ইসলামের সর্বনাশ করছেন। এই অবস্থা চলতে থাকলে আমাদের নিজস্ব পরিচিতি, জাতীয় সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা আমাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মুছে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ হিসেবে আমাদের স্বীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির চর্চা, প্রচার, প্রসারের এবং বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর আর কোন বিকল্প পথ নেই।
সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সৎ, দক্ষ ও দেশপ্রেমিক মানুষের অভাবে তা আজও সম্ভব হয়ে উঠেনি। বরং বিগত ৩৮ বছরের ইতিহাস কেবল পিছিয়ে পড়ার ইতিহাস। কারণ এদেশে যখন সবাই ক্ষমতাসীন হন, তারাই জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তনের চাইতে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত থাকেন বেশী। ফলে একুশ শতকে এসে বিশ্বের সকল জাতি যখন একবিংশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে তখন আমাদের অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অপসংস্কৃতির সয়লাব, শিক্ষাঙ্গনে সীমাহীন সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্য, শাসকদের দুর্নীতি, দলীয়করণ ও অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে সর্বত্রই সমস্যার পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে। এই সমস্যার সবাই সমাধান চায়। কিন্তু তার পরেও সমাধান হচ্ছে না। তার কারণ উপলব্ধি করতে হবে। মুক্তি পাগল জনতা মুক্তির সন্ধানে আর মরিচীকার পেছনে ছুটতে রাজি নয়। তাই সমস্যা চিহ্নিত করে নির্ণয় করতে হবে অধিকার বঞ্চিত এদেশের মুক্তি কোন পথে?
মুক্তির স্বাদ পেতে অনেক শ্লোগান আর মতবাদের কথা শুনেছি, শুনেছি আরো চমকপ্রদ বুলি। মা দিয়ে মানব রচিত মতবাদের ধারক ও বাহকগণ বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিভ্রান্ত করেছে। আমরা আর বিভ্রান্ত হতে চাই না। পেতে চাই শান্তি ও সুখের সন্ধান। পুঁজিবাদের শোষণের কবল থেকে মানবতাকে মুক্ত করে সাম্য প্রতিষ্ঠার মুখরোচক আওয়াজ দিয়ে যে সমাজতন্ত্র বিশ্ববাসীকে মার্কস, লেলিনের তত্ত্বের দিকে ধাবিত করার চেষ্টা করল, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সমাজতন্ত্রের অপমৃত্যু ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল মানুষ কোন দিনই মানুষের জন্য শান্তি ও মুক্তির পথ নির্ণয় করতে পারে না। মানুষের প্রকৃত কল্যাণ ও মুক্তি কোন কোন পথে তা তিনিই জানেন, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি হচ্চেন বিশ্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহ। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির পর বাতলে দিয়েছেন কিসে শান্তি, কোন পথে মুক্তি। মহান আল্লাহ প্রদত্ত শাশ্বত জীবনাদর্শ আল-ইসলামের পরিপূর্ণ অনুসরণ ও সমাজ জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমেই আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সত্যিকার উন্নতি সম্ভব। একমাত্র ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানব প্রেমই জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করতে পারে। তিন দিকে ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী আগ্রাসী শক্তির আগ্রাসন থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে ইসলামেই একমাত্র রক্ষাকবচ। সমাজ জীবন থেকে দুর্নীতি, অনিয়ম, নৈরাজ্য দূরীকরণে সৎ, যোগ্য, খোদাভীরু নেতৃত্বের বিকল্প নেই; যারা হবেন ইসলামী আদর্শের উজ্জ্বল প্রতীক, খোলাফায়ে রাশেদীনের অনুকরণে দেশের জনগণের সেবক হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। আদর্শহীন নেতৃত্ব থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন সৎ, যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও অসৎ নেতৃত্বের উৎখাত। বিশ্বব্যাপী মানব রচিত মতবাদের ব্যর্থতার প্রেক্ষিতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যে সর্বত্রই আওয়াজ উঠেছে "WE WANT ISLAM WE WANT QUARN" একথা আজ পরীক্ষিত ও সত্য যে, মানবতার মুক্তির জন্য ইসলামের বিজয় অনিবার্য।
আমাদের দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব নেই। তবুও দেশে শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষের দারিদ্র্য সীমার নিচে জীবনযুদ্ধে ব্যাপৃত। কৃষিপ্রধান এদেশের শতকরা ৬৩ ভাগ মানুষ ভূমিহীন, প্রায় দেড় কোটি কর্মক্ষম পুরুষ বেকার। ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বেকারত্ব আমাদের নিত্যসঙ্গী। এখনও না খেয়ে মানুষ মরার ঘটনা এদেশে ঘটে, লক্ষ লক্ষ মানুষ বাসস্থানের অভাবে মাথা গুজাবার ঠাঁই পায় না। ফুটপাতে, ষ্টেশনে, রাস্তার অলিতে-গলিতে মানবেতর জীবন-যাপন করছে অসংখ্য বনি-আদম। চিকিৎসার অভাবে প্রতিদিন মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে অসংখ্য লোক, শত শত অসহায় রুগ্ন, পঙ্গু, বিকলাঙ্গ মানুষের আত্ম-চিৎকারে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হচ্ছে। খাদ্য নিয়ে ডাষ্টবিনে মানুষের কাড়াকাড়ির দৃশ্য এদেশে এখনও চোখে পড়ে। অথচ দেশের সমুদয় সম্পদের সিংহভাগ ভোগ করেছে শতকরা ৮ জন ধনাঢ্য ব্যক্তিবর্গ। রাজধানীর অভিজাত এলাকায় গগণচুম্বি প্রাসাদগুলোতে তাদের বাস। পল্লীর কোটি কোটি বঞ্চিত মানুষের করুণ আহাজারি এদের কর্ণকুহরে পৌঁছায় না। তাই আল্লাহ আল-কুরআনে ঘোষণা করছেন, “তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে সংগ্রাম করছ না, অথচ নির্যাতিত নারী, পুরুষ ও শিশুরা আর্তনাদ করছে, হে প্রভু, জালিম অত্যাচারীদের জনপদ থেকে আমাদের মুক্ত কর এবং তোমার কাছ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী বন্ধু পাঠাও।” (সূরা আন-নিসা-৭৫)
পবিত্র আল-কুরআনের এ বিপ্লবী আহ্বান থেকে সুস্পষ্ট যে, নির্যাতিত নিপীড়িত অধিকার বঞ্চিত গণমানুষের জন্য মুক্তির জন্য সংগ্রাম চালানো মুসলমানের অপরিহার্য কর্তব্য।
আমরা মনে করি বাংলাদেশে একটি কাঙ্খিত পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা। ইসলামকে একটি বৈপ্লবিক মতাদর্শ হিসেবে যারা এদেশে তথা সারা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চায় তাদেরকে সংগঠনের মাধ্যমে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে তরুণ ছাত্র সমাজের রয়েছে বহু গুরু দায়িত্ব। কারণ তরুণ ছাত্র সমাজ হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে গতিশীল অংশ। এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি। দুনিয়ার কোন বিপ্লবই তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছাড়া সম্ভবপর হয়নি। আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে ছাত্র সমাজের দায়িত্ব আরো বেশী। তাই ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে ছাত্রদের সংঘবদ্ধ করে জাতীয় জীবনের সংকট মোকাবেলায় ভূমিকা পালন করা একান্ত প্রয়োজন।
বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ অত্যন্ত সচেতন। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন, স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ অতীতের বিভিন্ন আন্দোলনে এরা পালন করেছে ঐতিহাসিক ভূমিকা। অমাাদের দেশে সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বহু আগেই ছাত্র সমাজের মধ্যে গঠনমুখী আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। অবশেষে ১৯৭৭ সালে ৬ই ফেব্রুয়ারী রাজধানী ঢাকায় “বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির” এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের জন্য আত্মপ্রকাশ করে।
“বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির” প্রচলিত ধারার অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের ন্যায় চমকপ্রদ শ্লোগান সর্বস্ব কিংবা ইস্যুভিত্তিক কোন সাময়িক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে গঠিত হয়নি বরং আম্বিয়াযে কিরাম ও নবী রাসূলগণ পৃথিবীর মানুষকে যে মহান সত্যের পথে আহ্বান জানিয়েছিলেন সেই একই দাওয়াত নিয়ে ছাত্র সমাজের মধ্যে কাজ করতে চায়।
বাংলাদেশ তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। কিন্তু এদেশের শতকরা ৮৯.৭ জন লোক মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষের ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অঙ্গন কোন ক্ষেত্রেই আল্লাহর দেয়া বিধান আল ইসলামের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত নেই। বিশেষ করে শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ কথাটি আরও বেশী করে প্রযোজ্য। অথচ একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া এ জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
তাই দেশে ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার অনুপস্থিতির প্রেক্ষিতে ইসলামী ছাত্রশিবির একটি বিকল্প ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। আমরা ছাত্রদের কাছে ব্যক্তিগত যোগাযোগ, সাধারণ সভা, চা-চক্র, বনভোজন, নবাগত সম্বর্ধনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, বিতর্কসভা, রচনা ও বক্তৃতা প্রতিযোগিতা, সাধারণ জ্ঞানের আসর, পোস্টারিং, পরিচিতি, পুস্তিকা ও সাময়িকী বিতরণ ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ পরিচয় তুলে ধরার প্রয়াস চালাচ্ছি। সাথে সাথে ছাত্র সমাজকে স্ব-উদ্যোগে জ্ঞান অর্জনের আহ্বান জানাচ্ছি। কেননা ইসলামে জ্ঞান অর্জনকে ফরজ বা অবশ্য কর্তব্য বলে ঘোষণা করেছে এবং ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা) জ্ঞানার্জনের জন্য উৎসাহ দিতে গিয়ে বলেছেন প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশ পর্যন্ত ভ্রমণের।
মুসলমানরা মূলত: একটি মিশনারী জাতি, বিশ্বের সমস্ত মানুষকে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও আল্লাহর গোলামির দিকে আহ্বান করাই মুসলমানদের প্রকৃত মিশন। এজন্য আল কুরআনের ঘোষণা হচ্ছেঃ
“তোমারাই সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে মানুষের কল্যাণের জন্য, সৎ ও ন্যায় কাজের আদেশ দানের জন্য ও অসৎ কাজ থেকে মানব জাতিকে বিরত রাখার জন্য”। (সূরা আলে ইমরান-১১০)
অন্যত্র বলা হয়েছেঃ
“তার কথার চেয়ে উত্তম আর কার হতে পারে যে মানুষকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করে, নিজে নেক আমল করে এবং বলে আমি মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত”। (সূরা হামীম আস্ সেজদা-৩৩)
আল্লাহ আরও বলেছেন, “হে নবী! তোমার রবের দিকে ডাক উত্তম কথাবার্তার মাধ্যমে এবং তাদের সাথে যদি বিতর্ক করতে হয় তাহলে উত্তম তর্ক করো”। (সূরা আন নাহল-১২৫)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ঘোষণা হচ্ছে, “তোমরা আল্লাহর রজ্জুকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না”। (সূরা আলে ইমরান-১০৩)
অন্যত্র বলেছেনঃ “অবশ্যই মানুষের মধ্যে একটি সুসংগঠিত দল থাকা দরকার যারা মানব জাতিকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সত্য ও ন্যায় কাজ করবে এবং অন্যায় ও অসত্য থেকে মানব জাতিকে বিরত রাখবে”। (সূরা আলে ইমরান-১০৪)
যে কোন আন্দোলনের জন্য সংগঠন প্রয়োজন। সংগঠন বা সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা ছাড়া কোন আন্দোলনেই সফল হতে পারে না। বিশেষ করে সংঘবদ্ধ জীবন ছাড়া বিচ্ছিন্ন হয়ে সত্যিকারের মুসলমান থাকাটাই অসম্ভব। এজন্যই মহানবী (সা) বলেছেন, “যে ব্যক্তি জামায়াত (সংগঠন) থেকে বের হলো সে ইসলাম থেকে দূরে সরে গেল”। (আবু দাউদ)
আসলে ইসলামী আন্দোলনের গোড়া থেকেই আমরা সংগঠনের অস্তিত্ব দেখতে পাই। আজকের পঙ্কিলময় পরিবেশে তাগুতি শক্তির সর্বগ্রাসী ও চতুর্মুখী হামলার মুকাবেলায় এর প্রয়োজনীয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। বস্তুত: সংগঠন ছাড়া ইসলাম হতে পারে না। তাই হযরত ওমর (রা) বলেছেন, “লা ইসলামা ইল্লা বিল জামায়াত” অর্থাৎ সংগঠন ছাড়া ইসলাম নেই।
আল কুরআনে ইরশাদ হয়েছেঃ “তিনি সেই সত্তা যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদেরকে তাঁর আয়াতসমূহ পড়ে শুনান; তাদেরকে পরিশুদ্ধ করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন অথচ এর পূর্বে তারা সুস্পষ্ট গোমরাহীতে নিমজ্জিত ছিল”। (সূরা জুমার-২)
যে কোন আদর্শ বা আন্দোলন সফলতা ও স্থায়িত্বের জন্য প্রয়োজন সেই আদর্শের ছাঁচে তৈরী একদল কর্মীর, যারা স্বীয় কর্ম ও তৎপরতার দ্বারা উত্তম দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে। ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে একথা অধিকতর সত্য। ইসলামী আন্দোলন পরিচালনা এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্যে এর কর্মীবাহিনীর এমন চারিত্রিক মাধুর্যের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন যাতে সাধারণ মানুষ তাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। বাতিল ও জাহেলিয়াতের যাবতীয় চ্যালেঞ্জের সামনে তাদেরকে তুলনামূলক জ্ঞান ও যোগ্যতার দিক থেকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রতীয়মান হতে হবে। এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এ সংগঠনের সংঘবদ্ধ ছাত্রদেরকে প্রতিক্ষণের ব্যবস্থা করে। একদল ছাত্রকে শুধু সংঘবদ্ধ করা এবং চটকদার শ্লোগানে তাদেরকে আবেগপ্রবণ করে তোলা আমাদের কাজ নয়।
মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “তোমাদের মধ্য থেকে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদেরকে জ্ঞান দান করা হয়েছে তাদেরকে আল্লাহ উচ্চ মর্যাদা দেবেন। আর যা কিছু তোমরা কর, আল্লাহ সে বিষয়ে পূর্ণ অবহিত”। (সূরা আল-মুযাদালা-১১)
দেশের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার গলদ ও ব্যর্থতা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন ছাড়া জাতির জন্য কাঙ্খিত সুনাগরিক তৈরী সম্ভব নয়। তাই ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য আমরা প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবী জানিয়ে আসছি এবং এর প্রয়োজনীয়তাও জনসমক্ষে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এর সপক্ষে জনমত সংগ্রহের জন্যও আমাদের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। অতীতের কয়েকটি ঘটনাই প্রমাণ করছে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনতা ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থা চায়। কিন্তু সরকারী গড়িমসিই এর প্রধান অন্তরায়। তাই আমরা ইসলামী শিক্ষার সপক্ষে আপোষহীন সংগ্রাম চালাতে বদ্ধপরিকর।
অসৎ নেতৃত্বের অপসারণ ও সৎ নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসলামী বিপ্লব সাধন যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সমাজের কোন স্তরে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাও অসম্ভব। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চত্বরেও ইসলামী চরিত্র সম্পন্ন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি। তাই আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে থাকি।
আল কুরআনে এসেছে, “আল তোমাদের কি হল যে তোমরা আল্লাহর রাহে লড়াই করছো না দুর্বল সেই সব পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা নির্যাতিত হওয়ার কারণে ফরিয়াদ করেঃ হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদিগকে এই জনপদ থেকে নিস্কৃতি দান কর, এখানকার অধিবাসীরা যে অত্যাচারী! আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী পাঠাও”। (সূরা আন-নিসা-৭৫)
বিশ্বব্যাপী চলছে অন্যায়, জুলুম ও নির্যাতনের তান্ডবলীলা। মজলুম মানুষের আর্তচিৎকারে বিশ্ব বিবেক কম্পমান। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, রাজনৈতিক নির্যাতন, অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক সন্ত্রাস ও নৈরাজ্য এবং সাংস্কৃতিক গোলামীর জিঞ্জিরে মানবতা আজ বিপন্ন। আমাদের মাতৃভূমিও আজ অনুরূপ সমস্যার শিকার। নির্যাতিত, নিরন্ন ও ক্ষুধার্ত মানুষের হাহাকার, বস্ত্রহীনের করুণ আকুতি, সাংস্কৃতিক নোংরামী এখন আমাদের সমাজে নিত্যদিনের সাথী। একটা ব্যাপক সামাজিক বিপ্লব ছাড়া এর অবসান সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে নেতৃত্বের তথা রাজনৈতিক কর্তৃত্বের পরিবর্তন অপরিহার্য। কিন্তু তাই বলে একটা ছাত্র সংগঠন হিসেবে আমরা রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি না। একটা দায়িত্বশীল ছাত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমসাময়িক রাজনৈতিক তৎপরতার সাথে আমরা একাকার হয়ে যেতে পারি না। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, সাধারণ অবস্থায় আমরা জাতীয় সমস্যা থেকে দূরে থাকি। আত্মসচেতনতার সাথে জাতীয় সমস্যা অবলোকন করি এবং প্রয়োজন মুহূর্তে তা দূর করতে বলিষ্ঠ ও গণমুখী ভূমিকা পালন করি। জাতীয় সংকটকালে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।
ইসলামী আন্দোলনের যে কোন বৃহত্তম প্রচেষ্টাকে সহায়তা ও সমর্থন করা আমরা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। তবে তা করে থাকি আমরা সংগঠনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির সমাজে আল্লাহর পথে আহ্বানকারী একটি কাফেলার নাম। মুসলিম-অমুসলিম-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি আমাদের আহ্বান- আসুন, সকল প্রকার দল ও মতের ঊর্ধ্বে উঠে ইসলাম সম্পর্কে একটা সুস্পষ্ট ধারণা লাভ করার চেষ্টা করি এবং ব্যক্তি ও জাতির ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তির পথ খুঁজে বের করি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সত্যানুসন্ধানের আন্তরিক ইচ্ছা নিয়ে যিনি অগ্রসর হবেন, তিনি ইসলামকেই একমাত্র নির্ভুল ও পরিপূর্ণ জীবনদর্শন হিসেবে দেখতে পাবেন।
আসুন, বিভ্রান্ত মানবতাকে দেখাই আলোর রাজপথ, তাদেরকে ডাকি মহাসত্যের পথে। আসুন, দুনিয়ার মজলুম আদম সন্তানদের মুক্ত করি জালিমদের নির্মম প্রভুত্ব ও শোষণের নিগড় থেকে। তাদের পৌঁছে দেই ব্যর্থ মতবাদের ধাপ্পাবাজি থেকে সত্য ও সুন্দরের সোনালী দিগন্তে।
রাসূল (সা) হাদীসে বলেছেনঃ
“জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) হতে বর্ণিত। নবী (সা) বলেছেন, যে জাতির মধ্যে কোন এক ব্যক্তি পাপ কার্যে লিপ্ত হয়, আর উক্ত জাতির লোকেরা শক্তি রাখা সত্ত্বেও তা হতে তাকে বিরত রাখে না, আল্লাহ সে জাতির উপর মৃত্যুর পূর্বেই এক ভয়াবহ আযাব চাপিয়ে দিবেন”। (আবু দাউদ)
আসুন, অবক্ষয়মান তথাকথিত সভ্যতার ধ্বংস স্তূপের ওপর নির্মাণ করি কুরআন-সুন্নাহর অপ্রতিরোধ্য রাজতোরণ। চলুন আমরা দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাই একটা নতুন পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে। যেখানে থাকবে না মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব, শোষণ, জুলুম, নির্যাতন আর অত্যাচার; যেখানকার প্রতিটি নাগরিক আখিরাতের দৃষ্টিভঙ্গীতেই সবকিছু বিচার করবে এবং কেবল আল্লাহর সন্তোষ অর্জনকেই নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্যে পরিণত করবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে তাঁরই নির্দেশিত পথে নিষ্ঠার সাথে চলার তাওফিক দিন। আমীন॥
বাংলাদশে ইসলামী ছাত্রশিবির সম্পর্কে আরও জানতে হলে পড়ুন
১। এসো আলোর পথে।
২। মুক্তির পয়গাম।
৩। ছাত্র সংবাদ।
৪। Students Views
৫। কর্মপদ্ধতি।
৬। সংবিধান।
No comments
Thank You For your Comments.