adsterra.com

ক্যালিগ্রাফারদের সামাজিক মর্যাদা- আমিনুল ইসলাম আমিন

বিভিন্ন সময়ে মুসলিম সমাজে লিপিকারদের কিরূপ মর্যাদা ছিল  সে সম্বন্ধে কিছু আলোকপাত করছি। সে যুগে পুস্তক প্রকাশনা একটি আকর্ষণীয় সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন ঘটনা ছিলো। এর অর্থ ছিল একশ্রেণীর লিপিকারের পেশাদারি কাজে নিয়োগ অমরত্ব লাভের আশায়গ্রন্থকারের নাম অর্জন এবং  শিক্ষার্থীদের জ্ঞান লাভের উৎসের বিকাশ। দ্রুত অনুলিপি প্রস্তুতের জন্য লিপিকারদের মধ্যে প্রতিযোগিতার ভাব লক্ষ্য করা যেত।


ইয়াহহিয়া বিন আদি এমন একজন নিপুণ লিপিকার ছিলেন, তিনি চব্বিশ ঘন্টায় একশ পাতা লিপিবদ্ধ করতে পারতেন । লিপিকারদের পেশা লাভজনক হওয়ায় আলেমরা এবং গবেষকরা এই পেশা সাদরে গ্রহন করতেন। লিপিকারের সামাজিক মর্যাদা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ এভং শিক্ষক হিসেবেও তাদের নিয়োজিত করা হতো। লিপিকারেরা ছিলেন জ্ঞান তাপস ও প্রথিতযশা সাহিত্যিক এবং হস্তলিপিচর্চার মাধ্যমেও তারা তাদের সৃজনশীল ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারতেন।

প্রত্যেক জাতি তার সভ্যতা ও কৃষ্টির চুড়ান্ত পর্যায়ে শিক্ষায়তন এবং গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার সাক্ষর রেখে গেছেন। ক্যালিগ্রাফারের শিল্পকর্ম খুবই মাহর্ঘ্য ছিল এবং শিল্পীরসিকদের দ্বারা প্রশংসিত হতেন। চারশো পাতার একটি পান্ডুলিপির মূল্য তখন চারশো পাউন্ডে গিয়ে দাড়াতো। এসব শিল্পী পেশাগতভাবে ক্যালিগ্রাফির প্রতি সারাজীবন ধরে আকৃষ্ট হতেন এবং কঠোর নিয়মকানুন মেনে চলতেন।

এসব দক্ষ ও অভিজ্ঞ লিপিকার সমাজে দরবেশের মতো সম্মান লাভ করতেন এবং নৈতিক চারিত্রিক গুনাবলীর জন্য সমাদৃত হতেন। এমনকি রাজা বাদশাহ ও জনগন উন্নতমানের শিল্পকর্মের জন্য তাদের সম্মান করতেন। ক্যালিগ্রাফাররাও তাদের লিপিকলার গুরুত্ব সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। মীর খলিলুল্লাহ শাহ তার সময়ের একজন মর্যাদাবান লিপিকার ছিলেন।

তিনি যত্নসহ এবং দক্ষতার সঙ্গে নৌবাস- এর অনুলিপি প্রস্তুত করে দাক্ষিণাত্যের সুলতান ইব্রাহিম আদিল শাহকে উপহার দেন। সুলতান শিল্পীর অসামান্য নৈপুণ্য এবং উপহারে প্রীত হন। তিনি তাকে কলমের রাজা উপাধিতে ভূষিত করেন। সম্মান ও মর্যাদার নিদর্শন স্বরূপ তিনি তার সিংহাসনে বসতে দেন। অনুষ্ঠানের শেষে তিনি লিপিকারদের উপটৌকন দেন ৈএবং সভাসদদের দিয়ে তার বাসভবনে প্রেরণ করেন।

প্রথিতযশা লিপিকারদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আগা আবদুর রশীদ। তার লিপিকর্মের যথেষ্ট কদর ছিল। তিনি মীর ইমামের ভ্রাতুস্পুত্র ও শিষ্য ছিলেন। তিনি বাদশাহ শাহজাহানের রাজত্বে ভারতবর্ষে আগমন করেন এবং দারাশিক্যের ওস্তাদ নিযুক্ত হন। তিনি দারাশিকোকে নাসতালিক লিপিতে প্রশিক্ষণ দিতেন। তার জীবনের বেশীর ভাগ সময় আকবরাবাদে (আগ্রা) অতিবাহিত হয়  এবং মৃত্যুর পর তিনি সেখানেই সমাহিত হন।

তার ক্যালিগ্রাফির এমন দৃস্প্রাপ্য ও মহামূল্যবান ছিল যে, যাদের কাছে নিদর্শন ছিল তারা হারিয়ে যাওয়ার ভয়ে তা প্রদর্শন করতেন না। সম্রাদ জাহাঙ্গীর মোল্লা মীর আলীর ক্যালিগ্রাফির সমাদর করতেন। মীর তার দক্ষতা সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন। এবং প্রকাশ্য তা বলতেন । তার কবিতায় তিনি তার গুণাবলীর উল্লেখ করেন। “আমার কলম অসাধ্য সাধন করতে পারে”। অর্থ অপেক্ষা শাব্দিক গঠনের সৌন্দর্য ছিলো অসাধারণ। প্রতি অক্ষরের বক্রতাসমূহ যে বিশ্বভূবনকে দাসত্বে বরণ করে এবং প্রতিটি অক্ষরের টান যেন অমরত্ব দান করে।

ট্রাডিশনাল মুসলিম লিপিকলা চর্চার পাশাপাশি ভারত উপমহাদেশের সৃজনশীল আধুনিক শিল্পী ক্যালিগ্রাফাররা আরবী হরফের কদর বুঝেন  এবং উজ্জল সম্ভাবনা উপলব্ধি করে বিভিন্ন রীতিতে বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন উপকরণে মুসলিম লিপিকলার চর্চা করছেন। মুসলিম দেশের মতো স্বাধীনতা উত্তর আমাদের বাংলাদেশে গোড়ার দিকে ক্যালিগ্রাফি চিত্রকর্ম তেমন প্রাধান্য না পেলেও ট্রাডিশনাল এবং আধূনিক চিত্রকর্মের ধারায় বিক্ষিপ্তভাবে বাংলাদেশের শিল্পীরা সত্তর দশকের শেষের দিক থেকে লিপিকলার চর্চা করতে থাকেন, যা এখন দেশে বিদেশে ও আন্তর্জাতিকভাবে সুনাম অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।

এ দেশে প্রথিতযশা শিল্পীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- মোর্তজা বশীর, আবু তাহের, শামসুল ইসলাম নিযামী, ড. আব্দুস সাত্তার, সবিহ উল আলম, অধ্যাপক মীর মোঃ রেজাউল করিম, বশীর উল্লাহ, সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহিম মন্ডল, আরিফুর রহমান, শহীদুল্লাহ এফ বারী, মোঃ আব্দুর রহীম, মুবাশ্বির মজুমদার, হামিম কেফায়েত উল্লাহ, ফেরদৌস আরা আহমেদ, আবু দারদা, নিসার উদ্দিন জামিল, ও মানুন প্রমূখ।

লেখকঃ ক্যালিগ্রাফার আমিনুল ইসলাম আমিন। 

লেখকের ফেসবুক আইডি দেখতে পারেন। 

লেখকের কিছু ক্যালিগ্রাফি চিত্রকর্ম নিচে দেয়া হলো-


লেখক আমিনুল ইসলাম আমিন




No comments

Thank You For your Comments.

Powered by Blogger.
(function(i,s,o,g,r,a,m){i['GoogleAnalyticsObject']=r;i[r]=i[r]||function(){ (i[r].q=i[r].q||[]).push(arguments)},i[r].l=1*new Date();a=s.createElement(o), m=s.getElementsByTagName(o)[0];a.async=1;a.src=g;m.parentNode.insertBefore(a,m) })(window,document,'script','https://www.google-analytics.com/analytics.js','ga'); ga('create', 'UA-127411154-1', 'auto'); ga('require', 'GTM-WSRD5Q2'); ga('send', 'pageview'); (function(i,s,o,g,r,a,m){i['GoogleAnalyticsObject']=r;i[r]=i[r]||function(){ (i[r].q=i[r].q||[]).push(arguments)},i[r].l=1*new Date();a=s.createElement(o), m=s.getElementsByTagName(o)[0];a.async=1;a.src=g;m.parentNode.insertBefore(a,m) })(window,document,'script','https://www.google-analytics.com/analytics.js','ga'); ga('create', 'UA-127411154-1', 'auto'); ga('require', 'GTM-WSRD5Q2'); ga('send', 'pageview');