দেওবন্দি ধারাকে আমি ভালোবাসি...
কওমি অঙ্গন নিয়ে বোঝাপড়াটা ছিল ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া এবং মুখে মুখে প্রচলিত ধারণার উপর ভিত্তি করে। কওমিরা গোঁড়া, দুনিয়ার বাস্তবতা সম্পর্কে অজ্ঞ, জ্ঞানবিজ্ঞানে নস্যি, অনুদার, এগ্রেসিভ।
জীবনের ৩০টি বছর এভাবেই জেনে এসেছি। একজন কওমি ছাত্র দেখলেই আফসোস করতাম, সিম্পাথি চলে আসতো। আহা রে, ছেলেটে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির একজন! হয়তো দরিদ্র ঘরের একজন। বাবা-মা মুর্খ মানুষ। মিলাদ-মাহফিল করে দু-পয়সা যা পায়, তা দিয়েই এদের জীবনযুদ্ধ পাড়ি দিতে হবে।
বিগত ০২ বছর ধরে এই ধারার সাথে মিশেছি। কওমি ধারার আলিম, তালিবুল ইলমদের সাথে বেশ সময় কাটাতে হয়েছে। বলতে পারেন প্রকাশনা জগতে কাজ করার সুবাদে তাদের কাছাকাছি যেতে বাধ্য হয়েছি। কেন বাধ্য হয়েছি, তার ব্যাখ্যা কিছু পরে দিচ্ছি।
এই দুই বছরে আমি আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে বলতে পারি, কওমি জগত সম্পর্কে আমার ধারণা আমূল পাল্টে গেছে। স্বচক্ষে দেখেছি, এরা কতটা স্মার্ট, দক্ষ, মেধাবী, যোগ্যতাসম্পন্ন, শৈল্পিক। আমি খুব দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি ইসলামি ইলমি জগতে কওমি ধারার ধারেকাছেও আলিয়া ধারা নেই (দু-একজন ব্যক্তিক্রমি আলিম নিশ্চয় আছেন।)
একদিন রাত ২.০০টায় জামিয়া মাদানিয়া, বারিধারা মাদরাসা থেকে বের হচ্ছি। দেখছি, শতাধিক ছাত্র মসজিদে এবং বারান্দায় উচ্চস্বরে ইয়া বড়ো বড়ো কিতাব খুলে গ্রুপ গ্রুপ ভাগ হয়ে বসে পড়ছে। আমি একজন শিক্ষককে জিজ্ঞাসা করলাম- আগামীকাল কি পরীক্ষা? জবাবে উনি বললেন, না, এভাবে নিয়মিত রাত জেগে তারা অধ্যয়ন করেন। আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা নির্দিষ্ট নোট আর ক্লাসের লেকচার শুনে পরীক্ষার আগে ১০/১২ ঘণ্টা পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বড়ো সার্টিফিকেট নেই। আর এই তালিবুল ইলমরা জ্ঞানের জন্য সে কি করছে!
গত দু-বছরে আমি বেশ কয়েকজন কওমি আলিমের বাসায় গিয়েছি। সুবহানাল্লাহ। খুব সাধারণ মধ্যবিত্ত আলিমের বাসার ডেকোরেশনের স্মার্টনেস দেখে আমি থ হয়েছি। হয়তো কমদামি আসবাবপত্র; কিন্তু কী দারুণ গোছালো বাসা। নাস্তা পরিবেশনার স্মার্টনেস দেখে তব্দা হয়েছিলাম।
বারিধারা মাদ্রাসার একজন উস্তাদের কথা জানি। বড়ো ছেলে হাফেজ হয়ে দাওরাহ শেষ করে ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে এখন। আমাদের সাথে সেই উস্তাদ তখন কথা বলছিলেন। হঠাত একটা ফোন এলো। বুঝলাম, এয়ারপোর্টে নিজের গাড়ি নিয়ে ছেলেকে রিসিভ করতে যাবেন রাত ৩.০০ টায়। কী দারুণ প্যারেন্টিং। আমার বাবাও তো এতটা কেয়ারিং হয়ে এয়ারপোর্টে যেত না সম্ভবত।
গত বছর আমাদের একটা বই নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা উঠেছিল। আমরা বেশ অসহায় হয়ে পড়েছিলাম। মনটা এতটা খারাপ হয়েছিল, এক সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম- প্রকাশনা সেক্টরে আর থাকব না। কোনোভাবে এই তথ্য একজন কওমি বড়ো আলিম জেনে গিয়েছিলেন। উনি আমাকে ডাকলেন তার মাদ্রাসায়। টানা দুঘন্টা ফাও আলাপ করলেন আর নাস্তা খাওয়ালেন। শেষে বললেন,
'বেটা, তোমাকে দুই ঘণ্টা বসে রেখে একটু পরখ করলাম। তুমি আদৌ কতটা ধৈর্যশীল দেখলাম। আমি খুশি। জেনে রেখো- আল্লাহর সরাসরি বানী কুরআনুল কারিম নিয়েও প্রশ্ন তোলে জাহেলরা। আল্লাহর রাসূলের হাদিস নিয়ে কত নোংরামো হয়। আর তুমি তো বাচ্চা ছেলে? কেন প্রকাশনা সেক্টর ছেড়ে চলে যাবে? সমালোচনার ভয়ে? তুমি কি আল্লাহর রাসূলের চেয়েও পবিত্র, নিখুঁত? তোমার ভুল হবে না? তোমার সমালোচনা হবে না? কাজ করতে এসে এতটা ভীতু হলে চলে? তোমার ফেসবুক একাউন্ট দেখে তো মনে করেছিলাম, তুমি বিপ্লবী। আমার ধারণা ভুল; তুমিও সাধারণ এক আম পাবলিক।'
তিনি আরও বেশ খানিক সময় আমাকে বকাঝকা করেছিলেন। শেষে কপালে চুমো দিয়ে বলেছিলেন, 'চালিয়ে যাও; পাশে আছি।'
তার সেই কথাগুলো আজও ভুলতে পারিনি। আল্লাহু আকবার। উনি কওমি অঙ্গনের কিছু সীমাবদ্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার কথা অপকটে আমার সামনে তুলে ধরেছিলেন। একই সাথে কওমিদের দ্বীনের পেরেশানির জায়গাটা বুদ্ধিমত্তার সাথে তুলে ধরেছিলেন। সেদিনের ঘটনা আমার পেশাদার জীবনকে দারুণ ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছিল। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলা সত্তরোর্ধ এই বর্ষিয়ান আলিম ফেসবুকে আমাকে নজরে রাখে! আলি লজ্জায় সেদিন মাথা উঁচু করতে পারিনি।
প্রকাশনা সেক্টরে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, কওমি তরুণরা কতটা সৃজনশীল ও মেধাবী। বাংলা ভাষায় ইসলামি সাহিত্য কওমি তরুণদের স্পর্শে দূর্দান্ত গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। আলহামদুলিল্লাহ। ছুম্মা আলহামদুলিল্লাহ। আরবি ভাষায় কওমি তরুণদের যে দক্ষতা, তার ধারেকাছেও আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা নেই। (সৌদি আরব ও মিশরে অধ্যয়নরত কিছু আলিয়া ছাত্র এবং একান্তই ব্যতিক্রমী মেধাবী ছাড়া)। আরবি ও উর্দু কোনো বই অনুবাদ করতে হলে কওমি ধারার ছেলেদের বিকল্প আদতেই নেই। বাংলা ভাষায়ও কী দারুণ দখল তাদের!
কুরআন, হাদিস, ফিকহের দারুণ ইলমি গভীরতা। আসলে এই গভীরতা তাদের সাথে না মিশলে উপলব্ধি করতে পারতাম না। নির্দিষ্ট কয়েকটি আয়াত ও হাদিস মুখস্ত করে আমরা যে জ্ঞাণ ঝারতাম, তাদের কাছে গিয়ে তা যে কোথায় হারিয়ে যায়?
আমি আমার স্বতন্ত্র অবস্থান ও ভিন্ন চিন্তা কাঠামোর পরিচয় নিয়েই তাদের সাথে মিশেছি। আমি তাদের অবস্থানকে সম্মান করেছি, তারা আমার অবস্থানকে সম্মান করেছে। আমরা প্রচুর ডিবেট করেছি।
খুব অবাক হয়ে খেয়াল করেছি, আকিদা, আকিদা নিয়ে যে চিল্লাপাল্লা শুনতাম, সরাসরি কথা বলে তার ছিটেফোঁটাও দেখতে পাইনি। বরং, আমার মনে হয়েছে দেওবন্দ ধারার আকিদার খুব কাছাকাছি আমার চিন্তা, আমাদের চিন্তা। খানিকটা কাজ করলেই কিছু মতভিন্নতা দূর করা সম্ভব। প্রয়োজন আন্তরিকতা, খুলিসিয়াত আর বিনয়। প্রয়োজন আন্তঃচিন্তা ডায়ালগ।
আমি বরাবরই ভিন্ন ভিন্ন চিন্তাধারার তরুণদের নিয়ে আশাবাদী। প্রত্যেক ধারার তরুণরা ট্র্যাডিশনের উপরে উঠে নতুন করে ভাবছে। প্রত্যেক ধারার তরুণদের মাঝে আমি কোথায় যেন একটা কমন লক্ষ-উদ্দ্যেশ্য খুঁজে পাই। গত ১৫/২০ বছরে চিন্তা দুনিয়ায় বেশ বড়সড় পরিবর্তন এসেছে।
আমার কেন জানি মনে হয়, আগামীর দিনগুলো ভালো কিছুর দিন হবে। শুধু প্রয়োজন একটু উদারতা, সহিষ্ণুতা, সম্মানবোধ। বিশেষ করে তরুণদের আউট অব বক্স ভাবতে হবে, ভাবাতে হবে।
দেওবন্দ ধারার মধ্য দিয়ে বেড়ে না উঠেও আমি ব্যক্তিগতভাবে দেওবন্দ ধারাকে পছন্দ করি, ভালোবাসি। তাদের দ্বীনি অনুভূতি ও পেরেশানিকে সম্মান করি। তাদের জ্ঞানের প্রাচুর্যকে মর্যাদা দিতে চেষ্টা করি। তাদের মুআমেলাত আমাকে আকর্ষণ করে।
গতকাল থেকে অনলাইনে যা হচ্ছে, তা নিয়ে কিছুটা হতাশা কাজ করছে। মনে হচ্ছে, একটা দেওয়াল এসে আমাদের মজলিসকে আলাদা করতে চাইছে। প্লিজ, পিছিয়ে পড়া উম্মাহকে এগিয়ে নিতে আরেকটু সহনশীল হোন, আরেকটু প্রাজ্ঞ হোন।
কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাইয়ের ভাষায় বলি-
চলো চলো চলো মুজাহিদ
পথ যে এখনো বাকী
ভোলো ভোলো ব্যথা ভোলো
মুছে ফেলো ঐ আঁখি।
আসুক ক্লান্তি শত বেদনা
শপথ তোমার তবু ভুলনা
সময় হলে দিও আজান
তৌহিদের হে প্রিয় সাকী।।
তোমার ঘামের সঙ্গে মিশে
জাগবে সাড়া রাতের শেষে
উঠবে বেজে ভোরের সানাই
নীড়ছাড়া ওরে পাখী।।
ক্ষুধায় কদম চলতে চায়না
দৃষ্টি পথের সীমা পায়না
বাঁকের পরে বাঁক যে এসে
দূরের সাথে বাঁধে রাখী।।
ব্যথার পাথর বক্ষে চেপে
যেতে হবে তবু যে দূরে
থাম্লে তোমার চলবে নাতো
ভীরুর খ্যাতি চাও নাকি?
সান্তনা তব খোদার খুশী
এইতো পাওয়া রাশি রাশি
লোকের ঘৃনায় কি আসে যায়
খোদার সেই রঙ নাও মাখি।।
ভয়কি তোমার সংগী খোদা
দিলের কাবায় কোরান বাঁধা
মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী
কে বা তোমায় দেয় ফাঁকি।
No comments
Thank You For your Comments.