ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলন এবং করণীয়- আসাদ বিন হাফিজ।
আমরা যদি এ কথা স্বীকার করে নিই যে, বাতিল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন সত্যিকার অর্থেই আমাদের জন্য বিপুল ক্ষতি বয়ে আনছে, সাংস্কৃতিক চর্চা না করার কারণে আমাদের জাতিসত্তা আজ প্রচণ্ড হুমকির সম্মুখীন, সমাজের বুকে ইসলামী পরিবেশ রচনায় ইসলামী সাংস্কৃতিক চর্চা একটি অপরিহার্য মাধ্যম। ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত করতে হলে ইসলামী সংস্কৃতির ব্যাপক বিকাশ প্রয়োজন। শক্তিশালী একটি ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা হবে ঈমানের অপরিহার্য দাবি। এ দাবি পূরণ করতে হলে কেবল সাংস্কৃতিক চর্চা নয় বরং একটি সুপরিকল্পিত সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা করা অত্যাবশ্যক। সাংস্কৃতিক চর্চা আর সাংস্কৃতিক আন্দোলন একই জিনিস নয়। আমাদের প্রয়োজন সংস্কৃতিক চর্চার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলা। ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্রতিটি মানুষ যেন নিজেকে ইসলামের রঙে রাঙিয়ে তোলার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে ও অব্যাহত গতিতে প্রাণিত হয় তার জন্য যে প্রচেষ্টা তারই নাম ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলন। ইসলামী আন্দোলন যেমন জনগণকে ইসলামের দিকে প্রভাবিত করার মধ্যেই তার কাজকে সীমাবদ্ধ রাখে না, বরং সর্বস্তরে ইসলামের বিজয় চায়, তেমনি ইসলামী সাংস্কৃতিক আন্দোলনও কেবলমাত্র কিছুসংখ্যক সাংস্কৃতিক তৎপরতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না।
ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার একটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে প্রতিপক্ষকে জবাব দান। রাসূল (সা) বলেন, ‘এ তো অনস্বীকার্য, আল্লাহর রাসূলকে হেফাজত করার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়ে তোমরা অতন্দ্র প্রহরী হয়ে কাজ করছো। কলমের ভাষা দিয়ে তাকে আজ হেফাজত করার সময় এসে গেছে। কে আছো তীক্ষè মসির আঁচড় নিয়ে এগিয়ে আসবে?’ অন্য হাদিসে আছে, একবার হাসসান বিন সাবিতকে লক্ষ করে প্রিয়নবী (সা) বললেন, ‘তুমি আবু বকরের কাছে যাও। মুশরিকদের ইতিহাস ঐতিহ্য, তাদের বিবাদ বিসংবাদের কালো অধ্যায় তিনি তোমাকে আনুপর্বিক বলতে পারবেন। গুনে গুনে বংশের নানাদিক তোমাকে দেখাতে পারবেন। আর তুমিও সে আলোকে (প্রতিবাদ সূচক) নিন্দা কাব্য রচনা করতে পারবে। যাও তোমার সাথে জিবরাইল রয়েছেন।’ এ ধরনের আরো অনেক হাদিসে তিনি প্রতিপক্ষের জবাব দানের নির্দেশ দিয়েছেন এবং প্রতিপক্ষের দুর্বলতা খুঁজে বের করার তাগিদ দিয়েছেন। তাই আজ প্রতিপক্ষকে জানা এবং তার জবাব দানের জন্য এমন একটি পাঠাগার প্রয়োজন যেখানে ইসলামের পক্ষ ও বিপক্ষের সকল সাহিত্য ও সৃষ্টির সমাবেশ আছে। আমরা যদি সত্যিই একটি সফল ইসলামী সাংস্কৃতিক বিপ্লব সৃষ্টি করতে চাই তবে একটি সমৃদ্ধ লাইব্ররি আমাদেরকে অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। ইসলামী আন্দোলনের হাতিয়ার যেমন ইসলামী সংস্কৃতি তেমনি ইসলামী সংস্কৃতি চর্চার হাতিয়ার এ পাঠাগার। সাংস্কৃতিক কর্মীদের হাতে এ অস্ত্র না দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধের ময়দানে পাঠালে কখনোই ঈপ্সিত ফল আমরা লাভ করতে পারবো না।
একটি সফল ইসলামী সাংস্কৃতিক বিপ্লব সৃষ্টি করতে চাইলে জাতীয়ভিত্তিক একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তুলতে হবে। কারণ সাহিত্য ও শিল্প জাতীয় সম্পদ হলেও ব্যক্তিই তার উদ্ভাবক। ব্যক্তির এ সৃষ্টিকে সমষ্টির সামগ্রীতে পরিণত করতে পারে এ সংগঠন। যেমন খুলনার শিল্পীরা একটি চমৎকার গান তৈরি করলো। একটি জাতীয়ভিত্তিক সংগঠন থাকলে সে গানটি খুব সহজেই কেন্দ্রে চলে আসবে এবং কেন্দ্র থেকে তা আবার ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে। এভাবে সারাদেশ থেকে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিগুলো সংগ্রহ করে আবার তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া না গেলে আমরা বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি সম্ভারে কখনোই সমৃদ্ধ হতে পারবো না। আন্দোলনের স্বার্থে কখন কার কোন ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন কেন্দ্রীয় সংগঠন সে দিকনির্দেশনা দেবে। এ ছাড়া সারা দেশের সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে চিন্তার সমন্বয়, কর্মসূচির সমন্বয়, পারস্পরিক বিনিময়ের মাধ্যমে গুণগত উৎকর্ষ সাধনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন অপরিহার্য।
সাংস্কৃতিক আন্দোলনে কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীদের সহায়তা দান করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ মহানবীর নিম্নোক্ত বাণীটি থেকেই তা স্পষ্ট। রাসূল করীম (সা) বলেছেন, ‘কবিদের আর্থিক সহযোগিতা করা পিতামাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার সমতুল্য।’
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা) মসজিদে নববীতে একটি আলাদা উঁচু মিম্বর বানিয়েছিলেন, যে মিম্বর থেকে শুধুমাত্র কবিতা আবৃত্তি করা হতো। অন্য কোন কাজে এ মিম্বর ব্যবহার করা হতো না। তিরমিজি শরিফের হাদিস : ‘আয়েশা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মহানবী (সা) মসজিদে নববীতে হাসসান (রা)-এর জন্য উঁচু মিম্বর তৈরি করিয়ে নেন। তার ওপর চড়ে হাসসান (রা) নবীজীর গৌরবগাথা এবং মুশরিকদের উদ্দেশে প্রতিবাদ সূচক নিন্দা কাব্য আবৃত্তি করতেন। মহানবী বলতেন, ‘হাসসানের জিভ যতদিন রাসূলের পক্ষ হয়ে কবিতার বাণী শুনিয়ে যাবে, ততদিন তার সাথে জিবরাইল থাকবেন।’ এ মিম্বর বানানো থেকে এটা পরিষ্কার হয় যে কাব্যচর্চা ঐ সময় কোন হঠাৎ আবেগের বিষয় ছিলো না বরং ইসলামী আন্দোলনের একটি স্থায়ী কর্মসূচি ছিলো। সাহাবীগণ নিয়মিত সেখানে সমবেত হতেন এবং রাসূল (সা)সহ সকলে সম্মিলিতভাবে কবিতা আবৃত্তি শুনতেন। আর মসজিদে নববীতে অবস্থান করতেন সত্তর জন জ্ঞানসাধক ইতিহাসে যারা আসহাবে সুফফা নামে পরিচিত। এ থেকেইে কাব্য ও শিল্পকলার প্রতি ইসলামী আন্দোলনের বিকাশমান সময়ে মহানবী কতটা গুরুত্ব প্রদান করতেন তা অনুধাবন করা যায়। সাংস্কৃতিক তৎপরতার গুরুত্ব নির্ধারণের সময় এ বিষয়গুলো আমাদের স্মরণ করা দরকার।
আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন, পৃথিবীর প্রতিটি মানস পরিবর্তন মুখ্যত ঘটিয়েছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিন্তু তার পরিবেশ সৃষ্টি করেছে সাংস্কৃতিক কর্মীরা। সাংস্কৃতিক কর্মীরা হচ্ছে যুগের মুয়াজ্জিন আর রাজনৈতিক নেতারা ইমাম। আধুনিক বিশ্বের যুগের নকিবদের মুসলমানরা যতক্ষণ পর্যন্ত ময়দানে না পাঠাতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত লাব্বাইক লাব্বাইক বলে ঘর থেকে ছুটে আসবে না মুসল্লিরা। জনগণ কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়াবে না কোন ইমামের পেছনে, ইসলামী বিপ্লব সাধন সেখানে সম্ভব হবে না।
No comments
Thank You For your Comments.